উত্তর গাজায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ফিরছে ফিলিস্তিনিরা

উত্তর গাজায় ধ্বংসস্তূপের মধ্যে ফিরছে ফিলিস্তিনিরা

0
35
A-man-with-a-Palestinian-flag-walks-with-tens-of-thousands-of-others-who-were-forcibly-displaced-by-Israeli-forces-to-the-south-of-Gaza,-as-they-return-to-their-homes-in-the-north-on-Monday-[Fadel-A-A-Almaghari-Anadolu]

উত্তর গাজায় ভয়াবহ ধ্বংসযজ্ঞের মধ্যেও ৩ লক্ষাধিক ফিলিস্তিনি তাদের বাড়ি-ঘরে ফিরে এসেছেন। গাজার সরকারি মিডিয়া অফিস জানিয়েছে, দক্ষিণ গাজা থেকে উত্তর গাজায় এত বিপুল সংখ্যক মানুষ ফিরে আসার বিষয়টি নজরে এসেছে। তবে জাতিসংঘ সতর্ক করেছে যে, “মাঠ পর্যায়ে প্রয়োজনীয় সহায়তার চাহিদা এখনও বিপুল।”

আল জাজিরার এক প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, উত্তর গাজায় ফিরে আসা ফিলিস্তিনিরা সেখানে “শুধু ধ্বংসস্তূপই খুঁজে পাচ্ছেন।” একসময়কার প্রাণবন্ত উত্তর গাজার এলাকা এখন শুধুই ধ্বংসাবশেষ, যেখানে বাসিন্দারা তাদের জীবনের অবশিষ্টাংশ খুঁজে বের করার চেষ্টা করছেন।

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর শুরু হওয়া ইসরায়েলের সামরিক অভিযান গাজায় ভয়াবহ মানবিক সংকট সৃষ্টি করেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, এ যুদ্ধে এখন পর্যন্ত অন্তত ৪৭,৩০৬ জন ফিলিস্তিনি নিহত এবং ১,১১,৪৮৩ জন আহত হয়েছেন। এই ধ্বংসযজ্ঞে হাসপাতাল, স্কুল, এবং বাসস্থান সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে গেছে, যা ইতোমধ্যেই অবরুদ্ধ গাজার মানুষের কষ্ট আরও বাড়িয়ে তুলেছে।

জাতিসংঘের ফিলিস্তিনি শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা (UNRWA) গাজার সংকট নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। সংস্থার বিশেষজ্ঞরা এটিকে এক ভয়াবহ মানবিক বিপর্যয় হিসেবে অভিহিত করেছেন। “আমরা এক অভূতপূর্ব মানবিক বিপর্যয় প্রত্যক্ষ করছি,” উল্লেখ করে তারা অবিলম্বে আন্তর্জাতিক হস্তক্ষেপের আহ্বান জানিয়েছেন।

৭ অক্টোবর হামাসের নেতৃত্বে ইসরায়েলে চালানো আক্রমণে ১,১৩৯ জন নিহত হন। ঐ হামলায় আরও ২০০ জনের বেশি মানুষকে জিম্মি করে নিয়ে যাওয়া হয়। এই আক্রমণের প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েল গাজায় যে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে, তা এখন পর্যন্ত অঞ্চলের অন্যতম ভয়াবহ এবং ধ্বংসাত্মক সংঘাতে পরিণত হয়েছে।

গাজার পাশাপাশি অধিকৃত পশ্চিম তীরেও উত্তেজনা বৃদ্ধি পেয়েছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের প্রতি ইসরায়েলের দমননীতি আরও তীব্র আকার ধারণ করেছে। তাদের মতে, “পশ্চিম তীরে দমননীতি কোনোভাবেই শেষ হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।”

উত্তর গাজায় ফেরা ফিলিস্তিনিদের জন্য পরিস্থিতি অত্যন্ত চ্যালেঞ্জিং। অনেকেরই ঘরবাড়ি আর নেই। পুরো এলাকার রাস্তাঘাট, বাড়িঘর ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বিশেষ করে শিশুদের জন্য পরিস্থিতি ভয়াবহ। ইউনিসেফ (UNICEF) একে “শিশুদের হারানো শৈশবের সংকট” বলে অভিহিত করেছে। তাদের মতে, হাজার হাজার শিশু নিহত, আহত এবং এতিম হয়েছে।

তারপরও ফিলিস্তিনিদের দৃঢ় মনোবল অবিশ্বাস্য। ধ্বংসস্তূপের মধ্যেই মানুষ তাদের বাসস্থান খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে, প্রতিবেশীদের সঙ্গে পুনরায় যোগাযোগ করছে এবং নতুন করে জীবন শুরু করার চেষ্টা করছে। এক ফিলিস্তিনি আল জাজিরাকে বলেন, “এটাই আমাদের ঘর। এটা ধ্বংস হয়ে গেলেও আমরা এখানেই থাকব। যাওয়ার কোনো জায়গা নেই আমাদের।”

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় সংঘাত নিয়ে নানামুখী প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। জাতিসংঘ বারবার যুদ্ধবিরতি এবং গাজায় মানবিক সহায়তা পৌঁছানোর জন্য অবাধ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছে। তবে সহায়তা সংস্থাগুলো জানিয়েছে, চলমান সংঘাত এবং সরবরাহ চেইনের সমস্যার কারণে এই কাজটি করা অত্যন্ত কঠিন।

যুক্তরাষ্ট্র, ইসরায়েলের প্রধান মিত্র হিসেবে, এ সংঘাতে ইসরায়েলের প্রতি সমর্থন জানিয়ে সমালোচনার মুখে পড়েছে। মানবাধিকার সংগঠন এবং অ্যাডভোকেসি গ্রুপগুলো পশ্চিমা সরকারগুলোকে তাদের অবস্থান পুনর্বিবেচনার এবং সাধারণ মানুষের সুরক্ষা অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছে।

অধিকৃত পশ্চিম তীরে পরিস্থিতি আরও সংকটময় হয়ে উঠেছে। জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞরা উল্লেখ করেছেন যে, পশ্চিম তীরে সহিংসতা এবং ফিলিস্তিনিদের দমন-পীড়ন উল্লেখযোগ্যভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের মতে, “পশ্চিম তীরে ফিলিস্তিনিদের দমন কোনোভাবেই শেষ হওয়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।”

প্রতিবেদনে আরও বলা হয়েছে, পশ্চিম তীরের সহিংসতা সাম্প্রতিক দশকগুলোর মধ্যে সবচেয়ে চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। বছরের শুরু থেকে এখন পর্যন্ত সেখানে ২৫০ জনেরও বেশি ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। এসব মৃত্যু সাধারণত নিরাপত্তা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ বা বসতি স্থাপনকারীদের দ্বারা সংঘটিত হচ্ছে।

মানবাধিকার সংস্থাগুলো আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘনের জন্য দায়ীদের জবাবদিহি নিশ্চিত করার এবং দোষীদের বিচারের আওতায় আনার আহ্বান জানিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সংঘাত অঞ্চলে সম্ভাব্য যুদ্ধাপরাধের ব্যাপক প্রমাণ তুলে ধরেছে এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতকে (ICC) তদন্ত করার আহ্বান জানিয়েছে।

ফিলিস্তিনি কর্তৃপক্ষ জাতিসংঘের নিরাপত্তা পরিষদের একটি জরুরি বৈঠক ডাকার আহ্বান জানিয়েছে, যেখানে ফিলিস্তিনিদের আন্তর্জাতিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে আলোচিত হতে পারে।

গাজার সংঘাতের প্রভাব আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলেও ব্যাপকভাবে পড়ছে। বিশ্বজুড়ে প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। মানুষ যুদ্ধবিরতি এবং দীর্ঘদিনের ইসরায়েল-ফিলিস্তিন সংঘাতের ন্যায্য সমাধানের আহ্বান জানাচ্ছে।

ইউরোপ, উত্তর আমেরিকা, এবং মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন শহরে বিক্ষোভকারীরা ফিলিস্তিনের পতাকা হাতে নিয়ে রাস্তায় নেমেছেন এবং গাজার জন্য ন্যায়বিচারের দাবি জানিয়েছেন। বিক্ষোভকারীরা পশ্চিমা দেশগুলোর দ্বিমুখী নীতির সমালোচনা করেছেন এবং আন্তর্জাতিক আইন লঙ্ঘনের জন্য উভয় পক্ষের দায়বদ্ধতা নিশ্চিত করার আহ্বান জানিয়েছেন।

অবিশ্বাস্য ধ্বংসযজ্ঞ এবং জীবনহানির মধ্যেও কিছুটা আশা দেখা যাচ্ছে। মানবিক সংগঠনগুলো এবং সাধারণ জনগণ ক্ষতিগ্রস্তদের সহায়তায় এগিয়ে আসছে। খাদ্য, ওষুধ এবং অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র পৌঁছানোর জন্য মানবিক কর্মীরা নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিচ্ছেন।

যুদ্ধ চলমান থাকা সত্ত্বেও ফিলিস্তিনি জনগণের দৃঢ়তা এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সহায়তা তাদের আশার আলো জাগিয়ে রাখছে। তবে প্রশ্ন থেকেই যায়—বিশ্ব কি এই সংকটের অবসানে এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠায় কার্যকর পদক্ষেপ নেবে?

গাজা এবং অধিকৃত পশ্চিম তীরের পরিস্থিতি সংঘাতের মানবিক মূল্য এবং তা নিরসনে আন্তর্জাতিক পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তাকে তুলে ধরে। উত্তর গাজায় ফিরে আসা ৩ লক্ষাধিক মানুষের সংগ্রাম আমাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় যে, শান্তি, ন্যায়বিচার এবং মানবাধিকারের সুরক্ষার জন্য বৈশ্বিক পদক্ষেপ জরুরি।

যদিও আগামীর পথ কঠিন, ফিলিস্তিনিদের অদম্য মনোবল এবং ন্যায়বিচার ও জবাবদিহিতার জন্য ক্রমবর্ধমান আন্তর্জাতিক আহ্বান প্রমাণ করে যে মানব আত্মার শক্তি ধ্বংসের চেয়েও বড়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here