ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রেসিডেন্ট হিসেবে তার প্রথম দিনেই নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর করে যুক্তরাষ্ট্রকে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) থেকে প্রত্যাহারের আনুষ্ঠানিকতা শুরু করেন। এই সিদ্ধান্ত বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য ব্যবস্থার উপর বিরূপ প্রভাব ফেলতে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন। ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপ, যা রাজনৈতিক, আর্থিক ও মতাদর্শগত দৃষ্টিভঙ্গির বহিঃপ্রকাশ, আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সহযোগিতার ভবিষ্যৎ নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ডব্লিউএইচও: লক্ষ্য ও সাফল্য
১৯৪৮ সালে প্রতিষ্ঠিত ডব্লিউএইচও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর বৈশ্বিক স্বাস্থ্য সুরক্ষার লক্ষ্যে গঠিত হয়। এটি প্রতিষ্ঠার মূলনীতি ছিল স্বাস্থ্য মানুষের একটি মৌলিক অধিকার এবং স্বাস্থ্যের ক্ষেত্রে বৈষম্য মানবজাতির জন্য একটি সম্মিলিত হুমকি।
ডব্লিউএইচওর অন্যতম উল্লেখযোগ্য সাফল্য ছিল গুটিবসন্ত নির্মূল করা। ১৯৬৭ সালে সংস্থা গুটিবসন্ত নির্মূলের উচ্চাভিলাষী লক্ষ্য গ্রহণ করে। ব্যাপক টিকাদান এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার মাধ্যমে ১৯৭৭ সালে সোমালিয়াতে শেষ গুটিবসন্তের কেস পাওয়া যায় এবং ১৯৮০ সালে এটিকে নির্মূল ঘোষণা করা হয়।
সাম্প্রতিক বছরগুলোতে, ইবোলা ভাইরাস মোকাবিলায় ডব্লিউএইচও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। ২০১৪ থেকে ২০১৬ সালের মধ্যে পশ্চিম আফ্রিকায় ১১,০০০ জনের বেশি মানুষের প্রাণহানির সময় সংস্থাটি টিকা উন্নয়ন ও বিতরণে সহায়তা করেছে।
তবে, সংস্থাটি অদক্ষতা, আমলাতান্ত্রিক জটিলতা এবং বেসরকারি দাতাদের ওপর অতিমাত্রায় নির্ভরশীলতার জন্য সমালোচিত হয়েছে।
ট্রাম্পের ডব্লিউএইচও নিয়ে আপত্তি
ডোনাল্ড ট্রাম্পের ডব্লিউএইচওর প্রতি ক্ষোভ প্রধানত দুর্নীতি, অদক্ষতা এবং চীনের প্রতি পক্ষপাতিত্বের অভিযোগের ওপর ভিত্তি করে। কোভিড-১৯ মহামারীর সময় ট্রাম্প ডব্লিউএইচওকে সংকট “ভুলভাবে পরিচালনা করা” এবং ভাইরাসের উৎপত্তি গোপন করার অভিযোগ করেন।
ট্রাম্পের আরেকটি বড় আপত্তি ছিল অর্থায়ন। যুক্তরাষ্ট্র প্রতিবছর ডব্লিউএইচওকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন ডলার দেয়, যেখানে চীন মাত্র ৪০ মিলিয়ন ডলার অবদান রাখে। ট্রাম্প এই বৈষম্যকে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের শোষণের উদাহরণ হিসেবে উল্লেখ করেন।
ডব্লিউএইচও থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহারের প্রভাব
গবেষক লরেন্স গোস্টিন একে “পরবর্তী মহামারীর বীজ বপনের সমান” হিসেবে উল্লেখ করেছেন। যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউএইচওর প্রায় ২০% বাজেট সরবরাহ করে, যা যক্ষ্মা, এইচআইভি, এবং পোলিওর মতো রোগের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্যবহৃত হয়।
ডব্লিউএইচও আন্তর্জাতিক স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করে। তথ্য ভাগাভাগি, সম্পদ বরাদ্দ, এবং সম্মিলিত প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে এটি দেশগুলোকে সহায়তা করে।
এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের গ্লোবাল পাবলিক হেলথ বিভাগের প্রধান দেবী শ্রীধর বলেছেন, “আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ছাড়া মহামারীর বিরুদ্ধে লড়াই করা সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্র ডব্লিউএইচওর মতো সংস্থার সঙ্গে কাজ না করলে তাদের জাতীয় নিরাপত্তা দুর্বল হয়ে পড়বে।”
ট্রাম্পের সিদ্ধান্তের প্রতিক্রিয়া
ডব্লিউএইচওর মহাপরিচালক টেড্রোস আধানম গেব্রিয়েসাস এই সিদ্ধান্তে দুঃখ প্রকাশ করেছেন এবং যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে ডব্লিউএইচওর দীর্ঘ সহযোগিতার কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তিনি বলেন, “গুটিবসন্ত নির্মূল থেকে শুরু করে পোলিও নির্মূলের দ্বারপ্রান্তে পৌঁছানো পর্যন্ত যুক্তরাষ্ট্র এবং ডব্লিউএইচও একসঙ্গে অসংখ্য প্রাণ রক্ষা করেছে।”
জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন যে, এই সিদ্ধান্ত বর্তমান এবং ভবিষ্যৎ স্বাস্থ্য সংকট মোকাবিলায় বাধা সৃষ্টি করতে পারে।
বৃহত্তর প্রেক্ষাপট ও ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা
ট্রাম্পের সিদ্ধান্ত তার প্রশাসনের বহুপাক্ষিকতাবিরোধী অবস্থান এবং আর্থিক বৈষম্যের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থানের প্রতিফলন।
তবে, এই প্রক্রিয়া সম্পন্ন হতে এক বছর সময় লাগে, যা সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার সুযোগ তৈরি করে। ২০২১ সালে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ডব্লিউএইচওতে পুনঃপ্রবেশের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিশ্রুতি পুনর্নবীকরণ করেন। তবে ট্রাম্পের নবায়িত প্রচেষ্টা এই প্রক্রিয়াকে দ্রুততর করার ইঙ্গিত দেয়।
ডব্লিউএইচও থেকে যুক্তরাষ্ট্রের প্রত্যাহার বৈশ্বিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনায় একটি গুরুত্বপূর্ণ মোড় নির্দেশ করে। যদিও অদক্ষতা ও আর্থিক বৈষম্যের সমালোচনা গুরুত্বপূর্ণ, তবে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার সুবিধাগুলো বিচ্ছিন্নতার ক্ষতির চেয়ে অনেক বেশি। বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্য হুমকি মোকাবিলায় সদস্য রাষ্ট্রগুলোর সক্রিয় সমর্থন অপরিহার্য। যুক্তরাষ্ট্রকে তার সিদ্ধান্তের দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব গুরুত্বসহকারে বিবেচনা করতে হবে, কারণ স্বাস্থ্য সুরক্ষা একটি আন্তঃসংযুক্ত বিশ্বের সম্মিলিত দায়িত্ব।