শিক্ষা একটি জাতির উন্নয়নের প্রধান হাতিয়ার। বিগত তিন দশকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থা অনেক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে গেছে। এ সময়ের মধ্যে শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি, নারীশিক্ষায় অগ্রগতি এবং প্রযুক্তির সংযোজনসহ বিভিন্ন ইতিবাচক দিকের পাশাপাশি কাঠামোগত দুর্বলতা, মানের অভাব এবং আন্তর্জাতিক পদ্ধতির সঙ্গে বৈসাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়।
বিগত ৩০ বছরের শিক্ষাপদ্ধতির বিবর্তন
১৯৯০-এর দশক থেকে বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থায় ধাপে ধাপে অনেক পরিবর্তন এসেছে।
১. শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি বৃদ্ধি:
- ১৯৯০ সালে ‘সবার জন্য শিক্ষা’ (Education for All) লক্ষ্য নিয়ে সরকার প্রাথমিক শিক্ষার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন সাধন করে।
- মেয়ে শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি চালু, বিদ্যালয়ে মধ্যাহ্নভোজ প্রদান, এবং গ্রামীণ এলাকায় বিদ্যালয় স্থাপন উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
২. মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক স্তরে পরিবর্তন:
- ২০০৯ সালে শিক্ষানীতি প্রণীত হয়, যেখানে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হয়।
- কারিগরি শিক্ষার প্রসার এবং মাদ্রাসা শিক্ষার আধুনিকায়নেও উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
৩. উচ্চশিক্ষায় উন্নয়ন:
- বিগত তিন দশকে নতুন পাবলিক ও প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ের সংখ্যা বেড়েছে।
- ই-লার্নিং ও অনলাইন কোর্সের প্রচলন শিক্ষায় নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে।
৪. প্রযুক্তির সংযোজন:
- মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম, ডিজিটাল কন্টেন্ট এবং শিক্ষার্থীদের জন্য ল্যাপটপ বিতরণ উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ।
আন্তর্জাতিক পদ্ধতির সঙ্গে তুলনা
১. পাঠ্যক্রমের গুণগত মান:
- বাংলাদেশের পদ্ধতি:
- বাংলাদেশের পাঠ্যক্রম তুলনামূলকভাবে তথ্যভিত্তিক এবং মুখস্থনির্ভর। এখানে জ্ঞান ও তথ্যের সমৃদ্ধি ঘটলেও কর্মক্ষেত্রে তার প্রয়োগ সুবিন্যস্ত নয়। ধর্মের মাধ্যমে চরিত্র গঠনের পদ্ধতি থাকলেও সামাজিকতার প্রভাবে তার প্রয়োগ ঘটে না বল্লেই চলে।
- আন্তর্জাতিক পদ্ধতি:
- ফিনল্যান্ড, কানাডা বা জাপানের মতো দেশের শিক্ষাপদ্ধতিতে ক্রিটিকাল থিংকিং, সমস্যা সমাধান এবং গবেষণার ওপর জোর দেওয়া হয়।
- উদাহরণস্বরূপ, ফিনল্যান্ডে শিক্ষার্থীদের সৃজনশীলতা বিকাশের জন্য পরীক্ষার পরিবর্তে প্রকল্পভিত্তিক মূল্যায়ন করা হয়।
২. শিক্ষকের দক্ষতা:
- বাংলাদেশের পদ্ধতি:
- বাংলাদেশে শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতা উন্নয়নের কার্যক্রম তুলনামূলকভাবে সীমিত। আর থাকলেও তা রাজনিতির দ্বারা প্রভাবিত হওয়ায় শিক্ষকদের মানউন্নয়নে অমনোযোগীতা, পাঠদানে বানিজ্যিকিকরন ও অপেশাদার হয়ে ওঠা শিক্ষাকার্যক্রমকে বেশিরভাগক্ষেত্রে দুরহ করে তুলেছে।
- আন্তর্জাতিক পদ্ধতি:
- সিঙ্গাপুর বা ফিনল্যান্ডে শিক্ষকদের পেশাগত উন্নয়নে দীর্ঘমেয়াদি এবং নিয়মিত প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক।
- শিক্ষকদের উচ্চতর শিক্ষাগত যোগ্যতা অর্জন এবং গবেষণার সুযোগ নিশ্চিত করা হয়।
৩. প্রযুক্তি ব্যবহার:
- বাংলাদেশের পদ্ধতি:
- বাংলাদেশে প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়লেও তা এখনো শহুরে এলাকার মধ্যে সীমাবদ্ধ। গ্রামীন অবকাঠামোগত দুর্লতা ও সঠিক বাস্তবসম্মত পরিকল্পনার অভাব এখানে প্রকট।
- আন্তর্জাতিক পদ্ধতি:
- দক্ষিণ কোরিয়া এবং এস্তোনিয়ার মতো দেশগুলোতে শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার অত্যন্ত উন্নত এবং সবার জন্য সহজলভ্য।
- ভার্চুয়াল রিয়েলিটি (VR), কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) এবং ইন্টারেক্টিভ ডিজিটাল কন্টেন্টের মাধ্যমে শিক্ষাকে আরও কার্যকর করা হয়।
৪. শিক্ষায় সমতা:
- বাংলাদেশের পদ্ধতি:
- বাংলাদেশে শিক্ষাক্ষেত্রে জেন্ডার সমতা আনা সম্ভব হলেও গ্রামীণ এবং শহুরে শিক্ষার মধ্যে মানের পার্থক্য রয়েছে।
- আন্তর্জাতিক পদ্ধতি:
- নরওয়ে বা ডেনমার্কের মতো দেশগুলোতে শিক্ষায় সমতা নিশ্চিত করতে আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করা হয়েছে।
৫. মূল্যায়ন পদ্ধতি:
- বাংলাদেশের পদ্ধতি:
- বাংলাদেশের পরীক্ষানির্ভর মূল্যায়ন ব্যবস্থা শিক্ষার্থীদের চাপ বৃদ্ধি করে। পাশাপাশি প্রশাসনিক দুর্নিতী শিক্ষার পরিবেশের উপর মারাত্বক প্রভাব বিস্তার করে।
- আন্তর্জাতিক পদ্ধতি:
- যুক্তরাজ্য বা অস্ট্রেলিয়ায় ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং গঠনমূলক প্রতিক্রিয়ার মাধ্যমে শিক্ষার্থীদের দক্ষতা পরিমাপ করা হয়।
বাস্তবতার নিরিখে শিক্ষাব্যবস্থার ভিন্নতা
১. মুখস্থ নির্ভরতা:
বাংলাদেশে শিক্ষার্থীদের জ্ঞান যাচাই হয় মূলত মুখস্থবিদ্যার উপর ভিত্তি করে। তবে বাস্তব জীবনের সমস্যার সমাধান কিংবা দক্ষতা অর্জনে এটি তেমন সহায়ক নয়।
২. কর্মমুখী শিক্ষা:
বাংলাদেশে এখনো শিক্ষার অধিকাংশ অংশ তাত্ত্বিক। তবে আন্তর্জাতিক মানে কর্মমুখী শিক্ষা, বিশেষ করে প্রযুক্তি এবং কারিগরি শিক্ষার গুরুত্ব বেশি।
৩. অভিভাবকদের ভূমিকা:
আন্তর্জাতিক শিক্ষাব্যবস্থায় অভিভাবকদের শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য এবং শেখার প্রক্রিয়ায় সক্রিয় ভূমিকা রাখতে উৎসাহিত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটি এখনো সীমিত।
৪. শিক্ষায় বিনিয়োগ:
বাংলাদেশের শিক্ষা খাতে জাতীয় বাজেটের মাত্র ২-৩% ব্যয় হয়, যা আন্তর্জাতিক মানের তুলনায় অপ্রতুল। উদাহরণস্বরূপ, দক্ষিণ কোরিয়া শিক্ষায় বাজেটের ৭-৮% ব্যয় করে।
আগামীর শিক্ষাব্যবস্থার জন্য সংস্কারপথ
১. পাঠ্যক্রম আধুনিকায়ন:
- পাঠ্যক্রমে বাস্তবমুখী এবং কর্মমুখী বিষয় অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।
- চরিত্র গঠনে ধর্মের ব্যবহারকে জীবনমুখি করতে হবে যাতে ব্যক্তিজীবনে তার সঠিক প্রভাব পরিলক্ষেত হয়।
- সমস্যা সমাধান, সৃজনশীলতা এবং গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করতে হবে।
- কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবোটিকস, এবং উদ্ভাবনী প্রযুক্তি সংক্রান্ত বিষয় পাঠ্যক্রমে অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।
২. শিক্ষকের দক্ষতা উন্নয়ন:
- নিয়মিত প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে।
- পাঠ্যক্রমের প্রতিটি বিষয়কে ডিজিটাল করে তা সামাজিক মাধ্যমে শিক্ষক ও ছাত্রের ব্যাক্তিগত পরাশোনার মানউন্নয়নে ছড়িয়ে দিতে হবে পাঠ্যপুস্তকের সাথে সাথে বছরের শুরুতেই।
- শিক্ষকদের জন্য উচ্চতর ডিগ্রি এবং গবেষণার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
- বেতনের কাঠামো উন্নত করে এই পেশায় মেধাবী ব্যক্তিদের আকৃষ্ট করতে হবে।
৩. প্রযুক্তি সংযুক্তি:
- গ্রামীণ এবং শহুরে বিদ্যালয়ে সমানভাবে প্রযুক্তি সহজলভ্য করতে হবে।
- ই-লার্নিং প্ল্যাটফর্ম উন্নত করে সবার জন্য শিক্ষার সুযোগ বাড়াতে হবে।
- ডিজিটাল ল্যাব, স্মার্ট ক্লাসরুম এবং ভার্চুয়াল রিয়েলিটি ব্যবহার শিক্ষাকে আকর্ষণীয় করে তুলতে পারে।
৪. মূল্যায়ন পদ্ধতির সংস্কার:
- পরীক্ষানির্ভর ব্যবস্থার পরিবর্তে ধারাবাহিক মূল্যায়ন এবং প্রকল্পভিত্তিক পরীক্ষার প্রচলন করতে হবে।
- শিক্ষার্থীদের প্রতিক্রিয়া নেওয়া এবং তাদের দুর্বল দিক চিহ্নিত করে সেগুলো উন্নত করার ব্যবস্থা থাকতে হবে।
- স্থানীয় বিষয়াবলির উপর ভিত্তি করে শিক্ষকদের তদারকিতে শিক্ষাকার্যক্রমের এক ত্রীতিয়াংশ সময় কৃষি/মৎস/বনায়ন/বানিজ্জ্য সংশ্লিষ্ট বিষয়ে শিক্ষাগ্রহনের ব্যবস্থা রাখতে হবে। এতে করে শিক্ষক শিক্ষার্থির সঠিক মূল্যায়ন যেমন করতে পারবেন, শিক্ষার্থিও সমভাবে সেই বিষয়টিকে জীবনের বাস্তবক্ষেত্রে প্রয়োগে আগ্রহী ও উন্নয়নের জন্য গবেষনায় উদ্বুদ্ধ হবে।
৫. কর্মমুখী শিক্ষা:
- কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষার প্রসার ঘটাতে হবে।
- কর্মসংস্থানমুখী কোর্স এবং শিল্পপ্রতিষ্ঠানের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করতে হবে।
- উদ্যোক্তা তৈরির জন্য শিক্ষা কার্যক্রম চালু করতে হবে।
৬. শিক্ষায় বিনিয়োগ বৃদ্ধি:
- শিক্ষাখাতে বাজেট বৃদ্ধি করে অপচয়হীন অবকাঠামো এবং গবেষণায় বিনিয়োগ করতে হবে।
- সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্বের মাধ্যমে শিক্ষা খাতে অপচয় রোধ মুলক নতুন উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
৭. মানসিক স্বাস্থ্যের প্রতি মনোযোগ:
- শিক্ষার্থীদের মানসিক স্বাস্থ্য রক্ষায় পরামর্শদাতা নিয়োগ এবং সচেতনতা কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে।
৮. বৈষম্য দূরীকরণ:
- গ্রামীণ ও শহরের বিদ্যালয়ের মধ্যে মূল বিষয় গুলো মানের বৈষম্য দূর করতে হবে এবং বাস্তবতাকে মেনে নিয়ে শহর ও গ্রামের জন্য স্থানীয় চাহিদা মাথায় রেখে একটি প্রয়োজনিয় দৈতনীতির সুষম বিষয় ভিত্তিক বিন্যাস নিশ্চিৎ করতে হবে।
- সুবিধাবঞ্চিত শিক্ষার্থীদের জন্য বিশেষ স্কলারশিপ এবং আর্থিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে।
- স্থানীয় উৎপাদকদের সরাসরি শিক্ষাখাতের সাথে যুক্ত করা গেলে এর একটি সুদুরপ্রসারী উন্নত প্রভাব আমাদের দেশে লক্ষ করা যাবে অতি অল্প সময়ের মধ্যেই।–
বাংলাদেশের শিক্ষাব্যবস্থার গত ৩০ বছরের অগ্রগতি উল্লেখযোগ্য হলেও এর মান ও আন্তর্জাতিক পদ্ধতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণতা অর্জনে এখনো অনেক কাজ বাকি। শিক্ষায় গুণগত মান বৃদ্ধি, প্রযুক্তির ব্যবহার নিশ্চিত করা এবং কর্মমুখী ও চারিত্রীক উন্মেষের শিক্ষার প্রসার ঘটানোর মাধ্যমে একটি শক্তিশালী শিক্ষাব্যবস্থা গড়ে তোলা সম্ভব। ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এই সংস্কারগুলোই তাদের আন্তর্জাতিক মানে প্রতিযোগিতার উপযোগী করে তুলতে পারে।