গাজা যুদ্ধ ও ইসরাইলের নতুন বসতি বিস্তার কৌশল
২০২৪ সালে গাজা যুদ্ধ এবং ইসরাইলের বসতি বিস্তারের কৌশল আন্তর্জাতিক রাজনীতির এক গুরুত্বপূর্ণ আলোচনার বিষয় ছিল। গাজা উপত্যকায় হামাস এবং ইসরাইলের মধ্যে সংঘর্ষ নতুন মাত্রা পায়, যেখানে অসংখ্য সাধারণ মানুষের প্রাণহানি ঘটে। ইসরাইল তার সামরিক শক্তি দিয়ে গাজাকে অবরুদ্ধ করে রাখার কৌশল অব্যাহত রেখেছে। একই সঙ্গে পশ্চিম তীর এবং পূর্ব জেরুজালেমে নতুন বসতি গড়ে তুলছে, যা আন্তর্জাতিক নিন্দার মুখে পড়েছে।

আমেরিকা ইসরাইলের প্রতি নিরঙ্কুশ সমর্থন অব্যাহত রেখেছে। মার্কিন কংগ্রেস ইসরাইলের সামরিক বাজেট এবং প্রতিরক্ষা খাতে উল্লেখযোগ্য অর্থ বরাদ্দ দেয়। তবে এই সমর্থন বিশ্বমঞ্চে আমেরিকার নৈতিক অবস্থানকে প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জাতিসংঘের বেশ কিছু সদস্য দেশ ইসরাইলের বসতি বিস্তারের সমালোচনা করেছে। তা সত্ত্বেও, ইসরাইলের প্রতি মার্কিন কৌশলগত সহযোগিতা মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য বজায় রাখার মার্কিন লক্ষ্যকে পরিষ্কারভাবে তুলে ধরে।
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ও আমেরিকার প্রাপ্তি
রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ ২০২৪ সালে আরও তীব্র হয়। আমেরিকা ইউক্রেনকে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহায়তা দিয়ে রাশিয়াকে চাপে রাখতে সচেষ্ট ছিল। পশ্চিমা মিত্রদের সঙ্গে একত্রে আমেরিকা রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করে এবং ইউক্রেনকে অত্যাধুনিক অস্ত্র সরবরাহ করে। এই প্রক্রিয়ায় আমেরিকা ইউরোপীয় দেশগুলোর ওপর নিজের প্রভাব বাড়াতে সক্ষম হয়।

তবে যুদ্ধের ফলে বিশ্ব অর্থনীতি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। তেল ও গ্যাসের সরবরাহ সংকটে পড়েছে ইউরোপ, যা আমেরিকার তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (LNG) রপ্তানি বাড়ানোর একটি সুযোগ হিসেবে দেখা দিয়েছে। তাছাড়া, রাশিয়াকে চাপে রাখতে ন্যাটো সদস্য দেশগুলোর ঐক্য আরও সুসংহত হয়েছে। আমেরিকা এই যুদ্ধের মাধ্যমে রাশিয়াকে দুর্বল করার এবং ইউরোপের নিরাপত্তা ব্যবস্থায় নিজের আধিপত্য প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করেছে।
ইরানকে বশে রাখতে আমেরিকার ব্যর্থতা
ইরান ২০২৪ সালে আন্তর্জাতিক মঞ্চে নিজেদের অবস্থান আরও শক্তিশালী করেছে। পরমাণু সমঝোতা চুক্তি (JCPOA) পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা বারবার ব্যর্থ হয়েছে। ইরান তার পারমাণবিক কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দেয়, যা আমেরিকার জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। ইরানের অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও দেশটি চীন ও রাশিয়ার সঙ্গে অর্থনৈতিক ও সামরিক সহযোগিতা বাড়িয়ে নেয়।

মধ্যপ্রাচ্যে ইরানের উপস্থিতি আরো জোরালো হয়েছে। হিজবুল্লাহ, হুথি বিদ্রোহী এবং অন্যান্য প্রক্সি গোষ্ঠীর মাধ্যমে ইরান তার প্রভাব বজায় রেখেছে। এ ক্ষেত্রে আমেরিকার নীতি সঠিকভাবে কার্যকর না হওয়ায় ইরানকে বশে রাখা সম্ভব হয়নি। ইরান প্রশ্নে আমেরিকার ব্যর্থতা মধ্যপ্রাচ্যের রাজনৈতিক হিসাব-নিকাশে নতুন সমীকরণ তৈরি করেছে।
সিরিয়ার বিরোধীদের জয়লাভ ও নতুন মধ্যপ্রাচ্য সমীকরণ
সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে ২০২৪ সালে বিরোধী পক্ষ উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করে। সিরিয়ার প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকার রাশিয়া এবং ইরানের সমর্থন নিয়ে টিকে থাকলেও বিরোধী গোষ্ঠীগুলোর সাম্প্রতিক সাফল্য আমেরিকার মধ্যপ্রাচ্য কৌশলে নতুন দিগন্ত উন্মোচন করেছে। মার্কিন মদদপুষ্ট কুর্দি এবং আরব গোষ্ঠীগুলো সিরিয়ার পূর্বাঞ্চলে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ জোরদার করে।

এই পরিস্থিতি মধ্যপ্রাচ্যের জটিল ভূ-রাজনৈতিক পরিবেশে আমেরিকার প্রভাব বাড়ানোর একটি সুযোগ হিসেবে কাজ করে। সিরিয়ায় মার্কিন উপস্থিতি চীন এবং রাশিয়ার জন্য চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে। একই সঙ্গে, তুরস্কের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক কিছুটা জটিল হলেও তা পুরোপুরি ভেঙে যায়নি।
উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়া: চীনের বিপক্ষে আমেরিকার কৌশল
উত্তর কোরিয়ার পারমাণবিক পরীক্ষাগুলো ২০২৪ সালে আবারও বিশ্ব নিরাপত্তার জন্য হুমকি সৃষ্টি করে। দক্ষিণ কোরিয়া এবং জাপানের সঙ্গে আমেরিকা তার সামরিক সম্পর্ক জোরদার করেছে। কোরীয় উপদ্বীপে সামরিক মহড়া এবং ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থার আধুনিকায়নের মাধ্যমে আমেরিকা চীনের বিপক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নিয়েছে।
এদিকে, চীন উত্তর কোরিয়ার প্রতি তার সমর্থন অব্যাহত রাখে। এই পরিস্থিতি পূর্ব এশিয়ায় এক নতুন উত্তেজনার সৃষ্টি করে। আমেরিকার কৌশল চীনকে সামরিক ও অর্থনৈতিকভাবে চাপে রাখার চেষ্টা করলেও বেইজিং তার শক্তি প্রদর্শনে পিছপা হয়নি। ফলে, পূর্ব এশিয়ার ভূ-রাজনীতিতে এক জটিল পরিস্থিতি তৈরি হয়।
এই ঘটনাগুলো একসঙ্গে বৈশ্বিক রাজনীতির গতিপ্রকৃতিকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছে। নতুন বছর বিশ্বকে কোন পথে নিয়ে যাবে, তা নির্ধারণে এই বিষয়গুলোর গুরুত্ব অপরিসীম।