বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে চলা ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকদের দাবির মুখে, দেশের সমস্ত স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা পর্যায়ক্রমে জাতীয়করণের সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। টানা ১০ দিনের আন্দোলনের পর শিক্ষকদের দাবি মেনে নিতে বাধ্য হয়েছে সরকার।
শিক্ষকদের আন্দোলনের ফলাফল
মঙ্গলবার শিক্ষামন্ত্রণালয়ে আন্দোলনরত শিক্ষকদের সাথে অনুষ্ঠিত বৈঠকের পর এ সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়। এ বিষয়ে কারিগরি ও মাদরাসা শিক্ষা বিভাগের যুগ্ম সচিব এস এম মাসুদুল হক বলেন, “ইবতেদায়ী শিক্ষকদের ছয় দফা দাবি নীতিগতভাবে মন্ত্রণালয় গ্রহণ করেছে। সব দাবি পর্যায়ক্রমে বাস্তবায়ন হবে। প্রাথমিক পর্যায়ে ১৫১৯টি অনুদানভুক্ত মাদরাসাকে জাতীয়করণের প্রক্রিয়া ২০২৫ সাল থেকে শুরু করা হবে।”
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের এই ঘোষণার পর শিক্ষকরা চলমান আন্দোলন সাময়িকভাবে স্থগিত করেছেন। আন্দোলন বাস্তবায়ন কমিটির আহ্বায়ক মোঃ শামছুল আলম বলেন, “৩০ জুনের মধ্যে আমাদের সব দাবি মেনে নেয়ার আলটিমেটাম দিয়েছি। এরমধ্যে দাবি বাস্তবায়িত না হলে আমরা আবার কঠোর কর্মসূচি দেব।”
জাতীয়করণের প্রেক্ষাপট
১৯৭৮ সালের ৯ অর্ডিন্যান্স ২ এর ধারা অনুযায়ী প্রায় ১৮ হাজার স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাকে ১৯৮৪ সালে বাংলাদেশ মাদ্রাসা শিক্ষা বোর্ড কর্তৃক রেজিস্ট্রেশন দেওয়া হয়। ১৯৮৬ সালে প্রকাশিত একটি প্রজ্ঞাপনে প্রাইমারি ও স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাকে সমমান ঘোষণা করা হয়। ১৯৯৪ সালে শিক্ষকদের ৫০০ টাকা ভাতা প্রদান শুরু হয়। তবে এখনো পর্যন্ত এই শিক্ষকদের সম্পূর্ণ জাতীয়করণের আওতায় আনা হয়নি।
শিক্ষকরা বলছেন, জাতীয় শিক্ষা নীতিমালা ২০১০ অনুসারে প্রাথমিক শিক্ষার মতো ইবতেদায়ী শিক্ষাদান কার্যক্রম পরিচালিত হলেও এটি এখনও সরকারের দৃষ্টি থেকে অবহেলিত। অন্যদিকে ২০১৩ সালে ২৬ হাজার ১৯৩টি রেজিস্টার প্রাথমিক বিদ্যালয় জাতীয়করণ করা হলেও একটি স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাও জাতীয়করণের আওতায় আসেনি।
আন্দোলনের ধারাবাহিকতা ও সংঘর্ষ
গত ১৯ জানুয়ারি থেকে জাতীয় প্রেসক্লাবের সামনে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করেন স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসার শিক্ষকরা। একপর্যায়ে রোববার প্রধান উপদেষ্টার কাছে স্মারকলিপি দিতে গেলে পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং তাদের ওপর হামলা চালায়। এই ঘটনার পর আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। শিক্ষকেরা শাহবাগে অবস্থান নিয়ে লাগাতার কর্মসূচি পালন করেন।
এই অবস্থার মধ্যে শিক্ষামন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তাদের ঘোষণা শিক্ষকদের মধ্যে কিছুটা স্বস্তি এনে দিয়েছে। তবে শিক্ষকরা এখনো তাদের দাবির পূর্ণ বাস্তবায়ন চান।
শিক্ষকদের দাবি
শিক্ষক নেতারা জানিয়েছেন, তাদের প্রধান দাবি হলো—
- স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসাগুলোকে দ্রুত জাতীয়করণের আওতায় আনা।
- বকেয়া বেতন-ভাতাসহ সব আর্থিক সুবিধা প্রদান।
- একাডেমিক স্বীকৃতি প্রদানে বিলম্ব দূর করা।
- শিক্ষা ক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করা।
শিক্ষামন্ত্রণালয়ের যুগ্ম সচিব বলেছেন, “শিক্ষকদের ছয় দফা দাবি গ্রহণ করা হয়েছে। আমরা তাদের বাকি দাবিগুলো নিয়েও কাজ করছি। একাডেমিক স্বীকৃতির প্রক্রিয়া এই জুন মাসে চালু হবে।”
জাতীয়করণে সরকারের প্রতিশ্রুতি
শিক্ষা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, ২০২৫ সাল থেকে ধাপে ধাপে সব ইবতেদায়ী মাদরাসাকে এমপিওভুক্ত করার কাজ শুরু হবে।
শিক্ষকদের প্রতিক্রিয়া
শিক্ষক নেতা শামছুল আলম বলেছেন, “আমরা আন্দোলনে সফল হয়েছি। তবে আমাদের লক্ষ্য পূর্ণ জাতীয়করণ। আশা করি সরকার সময়মতো তার প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। যদি তা না হয়, তাহলে আমরা আরও কঠোর আন্দোলনে যেতে বাধ্য হব।”
স্বতন্ত্র ইবতেদায়ী মাদরাসা শিক্ষকদের এই দীর্ঘ আন্দোলন তাদের দাবি বাস্তবায়নের পথে গুরুত্বপূর্ণ একটি মাইলফলক স্থাপন করেছে। তবে সরকারের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের মধ্য দিয়েই শিক্ষকদের দীর্ঘ দিনের প্রত্যাশা পূর্ণ হবে। এজন্য সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ এবং সময়মতো জাতীয়করণের বাস্তবায়ন অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।