বিশ্বব্যাপী কোভিড-১৯ মহামারির প্রভাবে মানুষের জীবনযাত্রায় এক অসাধারণ পরিবর্তন এসেছে। স্বাস্থ্যসেবা খাতও এর থেকে ব্যতিক্রম নয়। করোনাভাইরাসের বিস্তার প্রতিরোধ করতে নানা ধরনের প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়েছিল, যা স্বাস্থ্য সেবার আধুনিকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। বাংলাদেশও এ ক্ষেত্রে পিছিয়ে ছিল না। বিশেষ করে টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা এবং নতুন হাসপাতাল নির্মাণের মাধ্যমে দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থা এক নতুন দিগন্তের দিকে এগিয়ে গেছে। ২০২৫ সালের দিকে এসে এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবায় আমূল পরিবর্তন নিয়ে আসছে।
১. টেলিমেডিসিন: দূরবর্তী অঞ্চলে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানোর উপায়। টেলিমেডিসিন প্রযুক্তি বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে একটি গুরুত্বপূর্ণ সংযোজন হিসেবে দাঁড়িয়ে আছে। মহামারির শুরুতেই শারীরিকভাবে হাসপাতালে যেতে অক্ষম রোগীরা দূরবর্তীভাবে চিকিৎসা নিতে শুরু করেন। এক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা ভিডিও কল, ফোন কল বা অন্যান্য ডিজিটাল মাধ্যম ব্যবহার করে রোগীদের পরামর্শ প্রদান করেন। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে টেলিমেডিসিন সেবা ব্যাপকভাবে চালু হয়, যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকারও টেলিমেডিসিন সেবা সম্প্রসারণে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখেছে। স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে, যার মাধ্যমে দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে প্রযুক্তির মাধ্যমে স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছানো সম্ভব হয়েছে। উদাহরণস্বরূপ, ‘টেলিমেডিসিন সেবা’ প্রকল্পের আওতায় মোবাইল স্বাস্থ্যসেবা ক্লিনিক চালু করা হয়েছে, যা সারা দেশের বিভিন্ন স্থানে স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে।
২. ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা: তথ্যের সহজ প্রবাহ। বাংলাদেশে ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবার ব্যবহার গত কিছু বছরে ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছে। এই সেবা চিকিৎসকদের জন্য রোগীর ইতিহাস, পরীক্ষার ফলাফল এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ তথ্য দ্রুত ও সহজে প্রবাহিত করতে সাহায্য করছে। পাশাপাশি, রোগীও তার চিকিৎসা সম্পর্কিত বিভিন্ন তথ্য স্মার্টফোনের মাধ্যমে পেতে সক্ষম হচ্ছেন। এই ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মের মাধ্যমে রোগীরা অনলাইনে রোগী নিবন্ধন, প্রেসক্রিপশন, চিকিৎসকের পরামর্শ এবং এমনকি বিল পেমেন্টও করতে পারছেন।
এছাড়া, মোবাইল অ্যাপস এবং ওয়েব পোর্টালগুলো রোগীদের জন্য স্বাস্থ্যসেবার দিশা নির্দেশ করছে। এগুলো থেকে রোগীরা তাদের শারীরিক অবস্থা সম্পর্কিত তথ্য পেতে পারেন এবং প্রয়োজনে ডিজিটাল পরামর্শ গ্রহণ করতে পারেন। এতে করে অপেক্ষার সময় কমে গেছে এবং রোগীকে চিকিৎসা প্রদান আরো সহজ ও কার্যকর হয়ে উঠেছে।
৩. নতুন হাসপাতাল নির্মাণ: সেবা ব্যবস্থার আধুনিকায়ন। বাংলাদেশে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি বৃদ্ধি এবং আধুনিক সুযোগ-সুবিধা প্রদান করার জন্য নতুন হাসপাতাল নির্মাণের কাজ চলছে। বিশেষত, শহর ও গ্রামীণ এলাকায় আধুনিক হাসপাতাল স্থাপন করা হচ্ছে, যেখানে উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহার করা হচ্ছে। সারা দেশে একাধিক হাসপাতাল এবং ক্লিনিক আধুনিক যন্ত্রপাতি এবং সুসজ্জিত কক্ষে রোগীদের সেবা প্রদান করছে। এই হাসপাতালগুলোর মধ্যে সুনির্দিষ্ট ভাবে কোভিড-১৯ রোগীদের জন্য আলাদা ইউনিটও তৈরি করা হয়েছে।
এছাড়া, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের উপস্থিতি এবং সর্বাধুনিক চিকিৎসা সেবা দেশের স্বাস্থ্যব্যবস্থাকে আরো শক্তিশালী করছে। ২০২৫ সালের মধ্যে আরো কয়েকটি নতুন হাসপাতাল উদ্বোধনের মাধ্যমে সেবা আরও সহজ এবং অধিকতর উন্নত হবে। পাশাপাশি, সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি খাতও নতুন হাসপাতাল এবং ক্লিনিক নির্মাণে উৎসাহিত হচ্ছে, যা দেশের স্বাস্থ্য সেবা ব্যবস্থার উন্নয়নে এক নতুন মাইলফলক হিসেবে বিবেচিত হবে।
৪. স্বাস্থ্যসেবায় উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহার। স্বাস্থ্যসেবা ক্ষেত্রে প্রযুক্তির আরও নানা উদ্ভাবনও ইতিমধ্যেই দেশের অভ্যন্তরে প্রয়োগ করা হচ্ছে। যেমন, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (AI) এবং মেশিন লার্নিং প্রযুক্তি রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে ব্যবহৃত হচ্ছে। এই প্রযুক্তিগুলি দ্রুততম সময়ে রোগী ও রোগের ধরণ চিহ্নিত করতে সক্ষম, যা ডাক্তারদের কাজকে সহজ এবং দ্রুত করে তোলে।
তাছাড়া, রোবোটিক সার্জারি, 3D প্রিন্টিং, এবং ব্লকচেইন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে হাসপাতালগুলোতে উন্নত চিকিৎসা সেবা প্রদান করা হচ্ছে। রোবোটিক সার্জারির মাধ্যমে জটিল অস্ত্রোপচার করা সম্ভব হচ্ছে, যা রোগীর দ্রুত সেরে উঠতে সাহায্য করছে। 3D প্রিন্টিংয়ের মাধ্যমে কাস্টমাইজড মেডিকেল ডিভাইস তৈরি করা হচ্ছে, যা রোগীর শরীরের সঙ্গে পুরোপুরি মেলে।
৫. ভবিষ্যৎ চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা। কোভিড-১৯ মহামারি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যখাতে প্রযুক্তির ব্যবহার বৃদ্ধির মাধ্যমে যদিও অনেক ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, তবুও কিছু চ্যালেঞ্জ এখনও বিদ্যমান। যেমন, উন্নত প্রযুক্তির প্রতি রোগীদের আস্থার অভাব, ডিজিটাল সেবার প্রতি শিক্ষার অভাব এবং কিছু এলাকায় ইন্টারনেট সংযোগের অভাব এখনও একটি সমস্যা হিসেবে রয়ে গেছে।
তবে এই চ্যালেঞ্জগুলো কাটিয়ে ওঠার জন্য সরকার এবং সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলো যথাযথ পদক্ষেপ গ্রহণ করছে। নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে সঙ্গতি রেখে প্রশিক্ষণ এবং জনসচেতনতা বৃদ্ধির জন্য বিভিন্ন প্রকল্প গ্রহণ করা হচ্ছে। স্বাস্থ্যখাতে উদ্ভাবনী প্রযুক্তির ব্যবহার আগামী দিনে আরো শক্তিশালী হবে, যা দেশের মানুষের জন্য স্বাস্থ্যসেবা আরও উন্নত এবং সুলভ করবে।
স্বাস্থ্যসেবায় প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে বাংলাদেশে এক নতুন যুগের সূচনা হয়েছে। কোভিড-১৯ পরবর্তী সময়ে টেলিমেডিসিন, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা এবং নতুন হাসপাতাল নির্মাণের মাধ্যমে দেশটি বিশ্ব স্বাস্থ্যসেবার মানদণ্ডে উন্নতির পথে এগিয়ে যাচ্ছে। ২০২৫ সালের মধ্যে বাংলাদেশের স্বাস্থ্যসেবা খাত আরও প্রযুক্তিনির্ভর এবং সাশ্রয়ী হবে, যা দেশের জনগণের স্বাস্থ্যসেবায় এক নতুন দিগন্ত খুলে দেবে।