পূর্ব আফ্রিকার দেশ ইথিওপিয়ায় সড়ক দুর্ঘটনা একটি দুঃখজনক কিন্তু প্রায়শই ঘটে যাওয়া ঘটনা। ৩০ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে দক্ষিণাঞ্চলীয় বোনা জুরিয়া এলাকায় ঘটে যাওয়া এক ভয়াবহ সড়ক দুর্ঘটনায় অন্তত ৬০ জন নিহত এবং আরও চারজন গুরুতর আহত হয়েছেন। এই মর্মান্তিক ঘটনা ইথিওপিয়ার সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার গুরুতর সীমাবদ্ধতাগুলোকে আবারও উন্মোচিত করেছে।
দুর্ঘটনাটি ইথিওপিয়ার দক্ষিণাঞ্চলে স্থানীয় সময় সকাল ১০:৩০ ঘটিকার দিকে ঘটে। একটি যাত্রীবাহী বাস, যা অতিরিক্ত যাত্রী নিয়ে রাজধানী আদ্দিস আবাবা থেকে হাওয়াসা শহরের দিকে যাচ্ছিল, নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে একটি গভীর খাদে পড়ে যায়। ঘটনাস্থলে থাকা প্রত্যক্ষদর্শীদের মতে, বাসটি অতিরিক্ত গতিতে চলছিল এবং রাস্তার বাঁক নিতে গিয়ে ড্রাইভার নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলে। দুর্ঘটনার সময় বাসে মোট ৭০ জন যাত্রী ছিলেন। স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতায় আহত যাত্রীদের দ্রুত হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে, তবে তাদের অনেকের অবস্থাই সংকটাপন্ন।
দুর্ঘটনার কারণ ও প্রাথমিক তদন্ত ক্ষতিয়ে দেখতে গিয়ে এই দুর্ঘটনার প্রধান কারণ হিসাবে যে বিষয়গুলো উঠে এসেছে, তা হলো; অতিরিক্ত গতি। প্রত্যক্ষদর্শীরা জানিয়েছেন, বাসটি অত্যন্ত দ্রুতগতিতে চলছিল। রাস্তার বাঁক নিতে গিয়ে নিয়ন্ত্রণ হারানোই দুর্ঘটনার মূল কারণ বলে মনে করা হচ্ছে। বোনা জুরিয়ার রাস্তাগুলো দীর্ঘদিন ধরে সংস্কারের অভাবে বিপজ্জনক অবস্থায় রয়েছে। এই রাস্তাগুলোতে পর্যাপ্ত সাইনবোর্ড এবং সতর্কীকরণ চিহ্নের অভাবও দুর্ঘটনার অন্যতম কারণ। দুর্ঘটনার সময় ড্রাইভার প্রায় ১২ ঘণ্টা ধরে টানা গাড়ি চালাচ্ছিলেন বলে জানা গেছে। ক্লান্তির কারণে তিনি ঠিকমতো সিদ্ধান্ত নিতে পারেননি। যাত্রীবাহী বাসটি তার ধারণক্ষমতার চেয়ে বেশি যাত্রী বহন করছিল। অতিরিক্ত ওজনের কারণে ব্রেকিং সিস্টেম কাজ করতে ব্যর্থ হয়।
ইথিওপিয়ার মতো নিম্নমধ্য আয়ের দেশে সড়ক দুর্ঘটনা একটি সাধারণ সমস্যা। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (WHO) প্রতিবেদন অনুযায়ী, ইথিওপিয়ায় প্রতিবছর প্রায় ২৫,০০০ মানুষ সড়ক দুর্ঘটনায় প্রাণ হারায়। এর পেছনের কারণগুলো হচ্ছে; অবকাঠামোগত দুর্বলতা, দেশটির অধিকাংশ সড়ক দীর্ঘদিন ধরে সংস্কার হয়নি। যানবাহনের অপ্রতুল মান, যাত্রীবাহী বাসসহ অনেক যানবাহন পুরনো এবং নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা হয় না। অপর্যাপ্ত আইন প্রয়োগ, সড়কে অতিরিক্ত গতি ও ওভারলোডিংয়ের মতো সমস্যাগুলো নিরসনে আইন প্রয়োগ যথাযথভাবে করা হয় না। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, দ্রুত নগরায়ণের ফলে রাস্তায় যানবাহনের চাপ বাড়লেও তার তুলনায় রাস্তাঘাটের উন্নতি ঘটেনি।
বোনা জুরিয়ার এই দুর্ঘটনা কেবল ব্যক্তিগত ক্ষতিই নয়, বরং জাতীয় স্তরেও গভীর প্রভাব ফেলেছে। এটি সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলোকে পুনরায় সামনে নিয়ে এসেছে। দুর্ঘটনার ফলে; নিহতদের পরিবারের সদস্যরা মানসিক ও আর্থিক সংকটে পড়েছেন। স্থানীয় সমাজে এই দুর্ঘটনার কারণে আতঙ্ক সৃষ্টি হয়েছে। আহত যাত্রীদের চিকিৎসার জন্য ব্যয় এবং যানবাহনের ক্ষতির কারণে অর্থনৈতিক প্রভাবও পড়েছে।
ইথিওপিয়ার সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার উন্নয়নে কিছু প্রস্তাবনা বিশ্লেষকগন তাদের গবেষনায় উল্লেখ করেছেন; প্রথমত দীর্ঘমেয়াদী সমাধানের জন্য রাস্তা সংস্কার ও আধুনিকায়ন জরুরি। বিপজ্জনক বাঁকগুলো সরলীকরণ এবং পর্যাপ্ত সাইনবোর্ড স্থাপন করা উচিত। দ্বিতীয় ধাপ হিসাবে পেশাদার ড্রাইভারদের জন্য নিয়মিত প্রশিক্ষণ ও ক্লান্তি ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব দেওয়া প্রয়োজন। এবং সড়কে অতিরিক্ত গতি নিয়ন্ত্রণে কার্যকর আইন প্রণয়ন এবং প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে। পাশাপাশি যানবাহনের জন্য নিয়মিত মেরামত এবং গুণগত মান যাচাইয়ের ব্যবস্থা করা উচিত। সর্বশেষে জনগণের মধ্যে সড়ক নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে গণমাধ্যম ও স্কুল পর্যায়ে প্রচারণা চালানো যেতে পারে।
এই দুর্ঘটনা আন্তর্জাতিক মহলে ইথিওপিয়ার সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। বেশ কিছু দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা ইথিওপিয়াকে প্রযুক্তিগত ও আর্থিক সহায়তা প্রদানের প্রস্তাব দিয়েছে। বিশ্বব্যাংক ও আফ্রিকান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকের মতো সংস্থাগুলো ইতিমধ্যেই সড়ক অবকাঠামো উন্নয়নে বিনিয়োগ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছে।
বোনা জুরিয়ার এই দুর্ঘটনা ইথিওপিয়ার সড়ক নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বলতাগুলো স্পষ্টভাবে প্রকাশ করেছে। নিহতদের পরিবারদের প্রতি গভীর সমবেদনা এবং আহতদের দ্রুত আরোগ্যের কামনা করছি। এই ঘটনার মাধ্যমে ইথিওপিয়া নতুন করে তাদের সড়ক অবকাঠামো এবং আইন বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার উন্নয়নের দিকে মনোযোগ দিতে পারে। সড়ক দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারলে, এই ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা ভবিষ্যতেও ঘটতে থাকবে। সড়ক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা শুধু সরকারের দায়িত্ব নয়, বরং প্রত্যেক নাগরিকের সচেতনতাও এক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।