বাংলাদেশে বন্যার ভয়াবহতা: একটি জাতি ডুবছে

বাংলাদেশে বন্যার ভয়াবহতা: একটি জাতি ডুবছে

0
47
Flood-in-bd

বাংলাদেশ, যা তার নদীপ্রবাহ এবং নিম্নভূমির জন্য পরিচিত, প্রতিটি বর্ষাকালে বন্যার তীব্রতার মুখোমুখি হয়ে থাকে। তবে, বর্তমান সময়ের বন্যাগুলোর প্রকৃতি এবং পরিণতি দেশের জন্য সত্যিই উদ্বেগজনক। প্রতিবেশী দেশের অব্যবস্থাপনা, পানির অপরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণ এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে এই বন্যা এখন শুধু এক মৌসুমী দুর্যোগে পরিণত হয়নি, বরং এটি বাংলাদেশের জন্য এক দীর্ঘস্থায়ী বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সারা বছর ধরে বৃষ্টিপাতের প্রভাব, নদী নদীতে অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি, সিডরের মতো প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং অবকাঠামোগত দুর্বলতা—এসব একত্রিত হয়ে বন্যাকে আরও ভয়াবহ করে তুলছে। এবারের বন্যা অতীতের যে কোনো বন্যার তুলনায় ভয়াবহ এবং একেবারে বিপর্যস্ত অবস্থায় দেশকে ফেলেছে। এই প্রতিবেদনে, আমরা বাংলাদেশে বন্যার প্রকৃতি, তার কারণ, ক্ষতির পরিমাণ এবং বন্যার বিরুদ্ধে সরকারের ও জনগণের উদ্যোগগুলোর আলোচনা করবো।

বন্যার কারণ: প্রকৃতি আর অব্যবস্থাপনা- বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান এমন যে, এটি প্রবল বর্ষণের ফলে ঘটে যাওয়া বন্যার ঝুঁকির মধ্যে পড়ে। দেশের বিস্তৃত নদী ব্যবস্থার মাধ্যমে প্রচুর পানি প্রবাহিত হয়, যা তলিয়ে দেয় নিচু এলাকাগুলোর ঘরবাড়ি, ফসলি জমি এবং অবকাঠামো। দেশের ৮০ শতাংশ অঞ্চলই নদী সংলগ্ন এবং প্রতি বছরই বর্ষাকালে এসব নদীগুলো অতিরিক্ত পানি ধারণ করতে গিয়ে আশপাশের এলাকা প্লাবিত করে ফেলে।

এর সাথে যুক্ত হয়েছে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের পানির অপরিকল্পিত নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা। ভারতসহ অন্যান্য দেশের পানি ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে অগ্রহণযোগ্য শর্তাবলী এবং বাংলাদেশের নদী-নালা ব্যবস্থার উপর সীমাহীন চাপ সৃষ্টি করেছে। মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং অন্যান্য ভারতের পাহাড়ি অঞ্চলে অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতের কারণে জলপ্রবাহ বাংলাদেশে প্রবাহিত হয়, যা প্রবল বন্যার সৃষ্টি করে। এছাড়া, পানি শোধন, বাঁধ নির্মাণ, এবং নদী শাসনের জন্য বাংলাদেশ সরকার প্রাথমিকভাবে কিছু পদক্ষেপ নিলেও, অনেক ক্ষেত্রে তা কাঙ্খিত ফলাফল এনে দিতে পারছে না।

জলবায়ু পরিবর্তন এই পরিস্থিতিকে আরও ভয়াবহ করে তুলেছে। বৈশ্বিক উষ্ণতার কারণে হিমবাহের বৈশ্বিক পরিবর্তন এবং প্রবল বর্ষণ বৃদ্ধি পাচ্ছে। জলবায়ু বিজ্ঞানীরা সতর্ক করেছেন, বাংলাদেশ আগামী দশকগুলোতে আরও তীব্র বন্যার কবলে পড়বে। এর ফলশ্রুতিতে দেশের আড়াই কোটিরও বেশি মানুষ বিপদে পড়তে পারে, যারা মূলত সাগর উপকূল, নদী তীরবর্তী এবং পাহাড়ি অঞ্চলে বসবাস করেন।

এবারের বন্যা: ভয়াবহতা এবং ক্ষতির পরিমাণ- ২০২৪ সালের বর্ষাকালে দেশব্যাপী যে বন্যা হয়েছে, তা ছিল বাংলাদেশের ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ। লাখ লাখ মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, হাজার হাজার ঘরবাড়ি নদী, খাল বা সাগরে তলিয়ে গেছে, ও কৃষি জমি সিক্ত হয়ে পড়ে। অধিকাংশ পরিবার নিজের ঘরবাড়ি হারিয়ে পুনরায় আশ্রয়ের সন্ধানে নেমেছে। এই ভয়াবহ বন্যায় প্লাবিত হয়েছে দেশের দক্ষিন পূর্বাঞ্চল ফেনী, কুমিল্লা ও নোয়াখালী যা কখনো প্লাবিত হয়না এবং উত্তর-পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলের অসংখ্য জেলা, যার মধ্যে সিরাজগঞ্জ, কুড়িগ্রাম, বগুড়া, জামালপুর, রংপুর ও মাদারিপুর অন্যতম। হাজার হাজার কৃষক তার ফসল হারিয়ে তাদের জীবিকা নির্বাহের পথ বন্ধ হয়ে গেছে।
ক্ষতির মধ্যে সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত গরীব জনগণ- বাংলাদেশে বন্যার সবচাইতে বড় ক্ষতি হয় গরীব জনগণের। যারা দিন আনে, দিন খায়, তারা সবচেয়ে বেশি বিপর্যস্ত। কৃষকরা নিজেদের ফসল হারিয়ে নিঃস্ব হয়ে গেছে। ইতিমধ্যে বাংলাদেশের গরীব জনগণ প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে সবচেয়ে বেশি পড়েছে। এই দেশের জনসংখ্যার প্রায় ৪০ শতাংশই দরিদ্র, এবং তাদের প্রধান জীবিকা কৃষি। তাই বন্যার ফলে তাদের জীবিকা, খাদ্য ও আশ্রয় সমস্যা তীব্র হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশটির সরকারি ও বেসরকারি ত্রাণ কার্যক্রম কিছুটা সহায়তা হলেও, ক্ষতিগ্রস্তদের পুরোপুরি পুনর্বাসন বা ঘরবাড়ি নির্মাণের কাজ অত্যন্ত কঠিন হয়ে দাঁড়িয়েছে।

এছাড়া, বাংলাদেশের বহু অঞ্চলের সরবরাহ চেইনও বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কৃষি সরঞ্জাম, খাদ্য সরবরাহ এবং স্বাস্থ্য সেবায় ব্যাপক প্রভাব পড়েছে। এদিকে, বিদ্যুৎ, রাস্তা, সেতু এবং অবকাঠামোর ভাঙাচোরা অবস্থা মানুষকে আরও কঠিন অবস্থায় ফেলেছে।

বন্যা মোকাবিলায় সরকারের কার্যক্রম- বাংলাদেশ সরকার বন্যার শুরু থেকে জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে। বন্যার কারণে জলমগ্ন এলাকাগুলিতে সেনাবাহিনী, রেড ক্রিসেন্ট, পুলিশ, ফায়ার সার্ভিস এবং বিভিন্ন এনজিও দ্রুত ত্রাণ বিতরণ করেছে। ত্রাণ সামগ্রী হিসেবে খাদ্য, মেডিকেল সহায়তা এবং অস্থায়ী আশ্রয় ব্যবস্থা প্রদান করা হয়েছে। সরকারের পক্ষ থেকে ত্রাণ কার্যক্রম চালানোর পাশাপাশি, প্রতিটি জেলা প্রশাসনের অধীনে সুশৃঙ্খল ব্যবস্থাপনার জন্য একটি কন্ট্রোল রুম স্থাপন করা হয়েছে।

তবে, প্রতিবছর বন্যা সামলানোর জন্য সরকারের সদর্থক উদ্যোগগুলি নির্দিষ্ট সীমানার মধ্যে সীমাবদ্ধ থাকে। প্রতি বছর সরকার বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করলেও, এবারের মতো ভয়াবহ বন্যা সবার প্রস্তুতির চেয়ে অনেক বড় আকার ধারণ করেছে। বিশেষত, বন্যার পানি নিষ্কাশনের জন্য নতুন ব্যবস্থা কিংবা সুনির্দিষ্ট দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনার অভাব অনেক বড় সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

জনগণের ক্ষোভ ও সরকারের প্রতি দাবী- বাংলাদেশের জনগণ বন্যার মোকাবিলায় সরকারের ব্যবস্থাপনায় কিছুটা হতাশ। অনেকেই মনে করেন, বন্যা মোকাবিলায় সরকার পর্যাপ্ত প্রস্তুতি নেয় না। বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাদের ক্ষতির পরিমাণ ও দুঃখ-কষ্টের কথা তুলে ধরে সরকারের কাছে দ্রুত কার্যকরী পদক্ষেপ আশা করছেন। তারা চাচ্ছেন যে, প্রতিটি বর্ষাকালে বন্যার পূর্বেই জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবিলায় কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হোক।

বিশেষ করে, নদী শাসন, বাঁধ নির্মাণ, ড্যাম্পিং ব্যবস্থাপনা এবং স্লুইস গেট স্থাপনে আরও উন্নত প্রযুক্তি ব্যবহারের আহ্বান জানানো হচ্ছে। ক্ষতিগ্রস্ত এলাকাগুলোর জন্য পুনর্বাসন এবং ত্রাণ কার্যক্রমের কার্যকরী পরিকল্পনা গঠন করার প্রয়োজনীয়তা সবার কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠেছে।

জলবায়ু পরিবর্তন এবং দীর্ঘমেয়াদী সমাধান- বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি পড়ছে। বন্যার মাত্রা বাড়ানোর জন্য এটি মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। বাংলাদেশ সরকারের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সমাজও জলবায়ু পরিবর্তন রোধে পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে। উন্নত প্রযুক্তির সাহায্যে পানি নিষ্কাশন ব্যবস্থা, বাঁধ নির্মাণ ও জলাশয়ের সংরক্ষণে আরও নতুন প্রকল্প গ্রহণ করতে হবে।

বাংলাদেশে বন্যার ভয়াবহতা একটি দীর্ঘস্থায়ী সংকটের পরিণত হয়েছে। প্রতিবছরই মানুষের জীবনে বন্যার তীব্রতা বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং দেশের জনগণের জন্য এটি এখন এক অনিবার্য ভয়। সরকারের প্রস্তুতি, ত্রাণ কার্যক্রম এবং আন্তর্জাতিক সহায়তা ছাড়া এই সংকট মোকাবিলা করা সম্ভব নয়। তবে, বাংলাদেশ শুধু ত্রাণ নয়, দীর্ঘমেয়াদী পরিকল্পনা এবং জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে গঠনমূলক পদক্ষেপ আশা করছে। মানবিক সহায়তা এবং প্রযুক্তির উন্নয়ন মাধ্যমে, এই সংকটে–র সমাধান সম্ভব হতে পারে, এবং বাংলাদেশের মানুষ একদিন এই ভয়াবহতাকে জয় করতে সক্ষম হবে—এমনটি আশা করা যায়।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here