বাংলাদেশের অর্থনীতি যেমন দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে, তেমনি সমাজের অন্ধকার কোণে লুকিয়ে থাকা এক করুণ বাস্তবতা ক্রমেই সামনে আসছে—শিশু শ্রম। বাংলাদেশের প্রগতির মাঝে একটি চিরন্তন সমস্যা হয়ে দাঁড়িয়েছে শিশু শ্রম। প্রতি বছর লাখ লাখ শিশু যে বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করে, তারা তাদের শৈশব হারিয়ে ফেলে, হারায় শিক্ষার অধিকার, এবং উপযুক্ত জীবনযাত্রার সুযোগ। উন্নয়নশীল অর্থনীতির মাঝে, যেখানে শ্রমিকদের প্রয়োজনীয়তা এবং উৎপাদন ক্ষমতা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেখানে শিশুদের কাজের পরিস্থিতি সামাজিক ও মানবিক প্রশ্ন হিসেবে দাঁড়িয়ে থাকে।
বিশ্বব্যাপী উন্নয়ন ও মানবাধিকার সংগঠনগুলি শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে এক দীর্ঘ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। তবে, বাংলাদেশে এই সংগ্রাম দীর্ঘ হলেও, কিছু আশার দৃষ্টান্তও সৃষ্টি হয়েছে। এখনও প্রচুর শিশুকে পোশাক শিল্প, ইটভাটা, রাস্তা, এবং অন্যান্য খাতের খণ্ডকালীন শ্রমিক হিসেবে কাজ করতে দেখা যায়, যা তাদের জীবনকে বিপজ্জনক, অবহেলিত এবং প্রতিকূল করে তোলে। এই শিশুদের অধিকাংশই পরিবারের অভাবের কারণে কাজ করতে বাধ্য হয়, কিন্তু কিছু ক্ষেত্রে তারা পাচার হয়ে যাওয়ার শিকারও হয়।
এই প্রতিবেদনটি বাংলাদেশে শিশু শ্রমের চিত্র, তার প্রভাব, এবং এটি নির্মূল করতে সরকারের উদ্যোগসহ সমাজের সর্বস্তরের প্রচেষ্টা সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনার চেষ্টা করবে।
বাংলাদেশের শিশুশ্রমের পরিস্থিতি ভয়াবহ। বিভিন্ন খাতে, বিশেষ করে পোশাক শিল্প, নির্মাণ ক্ষেত্র, ইটভাটা, কৃষি, রাস্তা-ঘাট পরিষ্কারের কাজ এবং অন্যান্য শিল্পে শিশুশ্রমের প্রচলন রয়েছে। এই শিশুরা ৬ থেকে ১৪ বছরের মধ্যে থাকে এবং দিনের পর দিন কাজ করতে হয়, যার ফলে তাদের শরীর এবং মন দুটোই চূড়ান্ত ক্ষতির সম্মুখীন হয়। বাংলাদেশের জাতীয় শ্রমিক সংগঠনগুলোর তথ্যমতে, দেশে ৪৫ লাখেরও বেশি শিশু শ্রমিক রয়েছে, যার মধ্যে অনেকেই ভারী শ্রমের পরিবেশে কাজ করছে, যেমন—পোশাক শিল্পে, গার্মেন্টস ফ্যাক্টরিতে, ইটভাটায়, স্ট্রিট ভেন্ডিং, রিসাইক্লিং, এবং আরও অনেক ক্ষেত্রে।
শিশু শ্রমের প্রধান কারণ হচ্ছে দারিদ্র্য। বাংলাদেশের ৩৪ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যসীমার নিচে বাস করে, এবং তাদের জন্য জীবনযাত্রার মৌলিক চাহিদা পূরণ করা একটি চ্যালেঞ্জ। এই অবস্থায়, পরিবারগুলো তাদের সন্তানদের কাজের জন্য পাঠিয়ে দেয়। শিশু শ্রমিকদের অধিকাংশই গ্রামীণ অঞ্চলের বাসিন্দা, যারা শিক্ষা ও উন্নত জীবনের সুযোগ থেকে বঞ্চিত। এছাড়া, নিন্ম আয়ের পরিবারের অভ্যন্তরীণ চাপও শিশুদের কাজ করতে বাধ্য করে। এসব শিশুর জীবন হয় আরও কঠিন, কারণ তাদের কাজের পরিবেশ অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং তাদের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলে।
শিশু শ্রমের যন্ত্রণা শুধুমাত্র তাদের শারীরিক অবস্থা নিয়েই সীমাবদ্ধ থাকে না, বরং এটি তাদের মানসিক ও সামাজিক বিকাশকেও ক্ষতিগ্রস্ত করে। কর্মক্ষেত্রে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করার কারণে শিশুরা শৈশবের আনন্দ ও শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। তাদের শিক্ষার সুযোগ বন্ধ হয়ে যায়, তারা বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে বড় হতে পারে না, এবং তাদের মধ্যে আত্মবিশ্বাস, সৃজনশীলতা এবং ভবিষ্যতের জন্য যে সম্ভাবনা থাকে, তা একে একে শেষ হয়ে যায়।
একটি ভাইরাল ছবি, যা সম্প্রতি সোশ্যাল মিডিয়াতে ছড়িয়ে পড়েছিল, একজন শিশুর মুখে কান্না, ক্লান্তি, এবং মলিন গায়ের কাপড়, যিনি একটি পোশাক কারখানায় কাজ করছিলেন, তা পৃথিবীজুড়ে মানুষকে নাড়িয়ে দেয়। শিশুটি তার বয়সের তুলনায় অনেক বেশি পরিশ্রমী ছিল, এবং তার চোখে ছিল অসীম ক্লান্তি ও বিষাদ। এই ছবি শুধু বাংলাদেশকেই নয়, বরং পুরো পৃথিবীকে এক নতুন চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি করেছে—শিশু শ্রমের অবসান।
এই ছবির পর থেকে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী শিশুদের অধিকারের প্রশ্ন আরও গুরুত্ব পায়। মানবাধিকার সংগঠনগুলি, সুশীল সমাজ, এবং স্থানীয় জনগণ একত্রিত হয়ে শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে লড়াই করছে। তারা দাবি করছে, শিশুদের প্রতি শোষণ বন্ধ করতে হবে, তাদের কাজের পরিবেশে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে, এবং তাদের শিক্ষার সুযোগ দেওয়ার জন্য সামাজিক প্রতিশ্রুতি নেওয়া উচিত।
বিশ্বব্যাপী কর্মসূচি ও প্রতিবাদগুলো শুধু বাংলাদেশের আইনকে আরও দৃঢ় করবে না, বরং আন্তর্জাতিক সমর্থনও পাবে। অনেক দেশ এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা এই অবস্থা দূর করতে বাংলাদেশকে সহায়তা দিতে চেয়েছে এবং তাদের আগ্রহের কারণ হলো—বাংলাদেশের শিশুদের ভবিষ্যতের অন্ধকার রূপটি আসলে তাদেরই ভবিষ্যতকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। ২০১৭ সালে ইউনিসেফ বাংলাদেশে একটি বিশেষ পরিকল্পনা গ্রহণ করে, যার মাধ্যমে তারা শিশু শ্রম বন্ধে সহায়তা প্রদানে উদ্যোগী হয়েছিল। সরকারের পাশাপাশি, অনেক এনজিও এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাও এই সংকট সমাধানের চেষ্টা করছে।
বাংলাদেশ সরকার, জাতিসংঘের শিশু অধিকার সনদ এবং অন্যান্য আন্তর্জাতিক সমঝোতার ভিত্তিতে, শিশু শ্রম বন্ধে বেশ কিছু উদ্যোগ নিয়েছে। সরকার ২০০০ সালে ‘জাতীয় শ্রম আইন’ প্রণয়ন করে, যা শিশু শ্রম নিষিদ্ধ করে এবং শিশুশ্রমের সাথে জড়িতদের শাস্তির বিধান করে। তবে, বাস্তবে এই আইন কতটুকু কার্যকর তা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে। শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে সরকারের পদক্ষেপের মধ্যে রয়েছে স্কুলগুলিতে বাধ্যতামূলক শিক্ষার ব্যবস্থা, সামাজিক নিরাপত্তা প্রকল্পের আওতায় দরিদ্র পরিবারের জন্য সহায়তা, এবং শিশু শ্রমিকদের জন্য পুনর্বাসন কেন্দ্র স্থাপন।
এই আইন এবং সরকারের পদক্ষেপ গুলি অনেকাংশে শিশুশ্রমের বিস্তার রোধ করতে সহায়ক হয়েছে, তবে পুরোপুরি নির্মূল করা এখনো সম্ভব হয়নি। দারিদ্র্য ও কর্মসংস্থানের সংকটের কারণে অনেক ক্ষেত্রে শিশুদের কাজ করা অবশ্যম্ভাবী হয়ে দাঁড়িয়েছে।
বাংলাদেশের শিশুদের জন্য একটি সুন্দর ভবিষ্যত তৈরি করতে হলে, শিশুশ্রম বন্ধ করতে হবে। তবে, এটি কোনো একক প্রচেষ্টায় সম্ভব নয়। সরকারের পাশাপাশি সুশীল সমাজ, বিভিন্ন এনজিও, এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলির একযোগ প্রচেষ্টার প্রয়োজন রয়েছে। প্রাথমিকভাবে, দারিদ্র্য দূরীকরণের জন্য সামাজিক সুরক্ষা ব্যবস্থা বাড়ানো, এবং শিশুদের জন্য সহজলভ্য শিক্ষা এবং স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
সামাজিক সচেতনতা গড়ে তোলা, স্থানীয় জনগণের মধ্যে শিশুশ্রমের বিরুদ্ধে তৎপরতা চালানো, এবং জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে এর বিরুদ্ধে প্রচারণা চালানো একটি কার্যকর উপায়। এসব পদক্ষেপ গ্রহণ করলে, বাংলাদেশকে শিশু শ্রম মুক্ত সমাজের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
বাংলাদেশে শিশু শ্রমের বিরুদ্ধে সংগ্রাম এখনও চলমান। দারিদ্র্য, অবহেলা, এবং অজ্ঞতার কারণে লাখ লাখ শিশু আজও বিপজ্জনক পরিবেশে কাজ করছে, তাদের শৈশব হারিয়ে ফেলছে এবং সম্ভাবনাগুলি শেষ হয়ে যাচ্ছে। তবে, শিশু শ্রম নির্মূলের পথটি দীর্ঘ হলেও, বাংলাদেশের মানুষ, সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলি যৌথভাবে এক নতুন দিনের সূচনা করতে সক্ষম হবে। শিশু শ্রমের অবসান না হলে, বাংলাদেশের ভবিষ্যত নিশ্চিতভাবে অন্ধকারে ডুবে যাবে। আমাদের দায়িত্ব, আমাদের কর্তব্য, এবং আমাদের প্রজন্মের কাছে একটি মানবিক ও সমৃদ্ধ ভবিষ্যতের প্রতিশ্রুতি পালন করার সময় এসেছে।