গাজায় ইসরায়েলি বাহিনীর সাম্প্রতিক হামলায় নিহতের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলেছে। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, ইসরায়েলি আক্রমণে নিহত ফিলিস্তিনিদের সংখ্যা ইতিমধ্যেই ৪৫,৫০০ ছাড়িয়েছে। গত ২৪ ঘণ্টায় আরও ৩০ এরও অধিক জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। নিহতদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য সংখ্যক নারী ও শিশু রয়েছে, যা এই সংঘাতের মানবিক দিককে আরও মর্মান্তিক করে তুলেছে।
গাজা উপত্যকা ১৯৪৮ সালে ইসরায়েল রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর থেকে একটি জটিল ও সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে পরিণত হয়েছে। ফিলিস্তিনের এই ছোট ভূখণ্ডটি বারবার ইসরায়েলি আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু হয়েছে দখলদারিত্বের লক্ষে। সম্প্রতি, গাজা থেকে ইসরায়েলের বিভিন্ন এলাকায় রকেট হামলার প্রতিক্রিয়ায় ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী (আইডিএফ) ব্যাপক আক্রমণ চালায়।
আইডিএফ দাবি করে, হামাস ও ইসলামি জিহাদের মতো সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর অবকাঠামো ধ্বংস করাই তাদের প্রধান উদ্দেশ্য। কিন্তু বাস্তবতা হলো, এই হামলায় সবচেয়ে বেশি এবং প্রকৃতঅর্থে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে বেসামরিক নাগরিকরা। গাজার স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের তথ্য অনুযায়ী, নিহতদের মধ্যে প্রায় ৬৫% বেসামরিক এবং তাদের একটি বড় অংশই শিশু ও নারী।
গাজা এখন কার্যত ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে। বিদ্যুৎ, পানি, ও খাদ্যের সংকট মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) জানিয়েছে, গাজার হাসপাতালগুলোতে ওষুধ ও চিকিৎসা সরঞ্জামের ঘাটতি চরমে পৌঁছেছে। আহতদের চিকিৎসা দেওয়া অসম্ভব হয়ে পড়ছে।
জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গাজার ৮০% মানুষ আন্তর্জাতিক মানবিক সহায়তার ওপর নির্ভরশীল। সংঘাতের কারণে প্রায় ১০ লাখ মানুষ সরাসরি গৃহহীন হয়ে পড়েছে। বোমা হামলায় ধ্বংস হয়েছে স্কুল, হাসপাতাল ও গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো। মানবিকতার শেষ আশ্রয়স্থল ক্যাম্পগুলোও ছাড় পাচ্ছেনা ইসরায়েলের বর্বর হামলার হাত থেকে।
গাজায় সংঘাত বন্ধে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বারবার আহ্বান জানালেও পরিস্থিতির তেমন কোনো উন্নতি দেখা যাচ্ছে না। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদ ও নিরাপত্তা পরিষদে গাজা সংকট নিয়ে আলোচনা হয়েছে। কিন্তু এই আলোচনা ফলপ্রসূ হয়নি। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলকে অনৈতিকভাবে একতরফা সমর্থন অব্যাহত রেখেছে, যা পরিস্থিতি আরও জটিল করে তুলেছে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ), তুরস্ক, এবং বিভিন্ন আরব দেশ ফিলিস্তিনিদের অধিকারের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে। তবে আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও, যুদ্ধবিরতি বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয়নি।
গাজার পরিস্থিতি মানবাধিকার লঙ্ঘনের জ্বলন্ত উদাহরণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ইসরায়েলের এই হামলাকে যুদ্ধশুরুর পরথেকেই যুদ্ধাপরাধ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল এবং হিউম্যান রাইটস ওয়াচ বলেছে, ইসরায়েলের হামলায় আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন ও জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করা হয়েছে যা অমার্জনিয় অপরাধ ও রাষ্ট্রিয় জঙ্গি তৎপড়তা ভিন্ন কিছুই নয়।
গাজা সংঘাত শুধু ফিলিস্তিন ও ইসরায়েলের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। এটি মধ্যপ্রাচ্যের স্থিতিশীলতাকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে। ইরান ও ইসরায়েলের উত্তেজনা সৃষ্টির প্রধান কারন এই হামলা। ইরান প্রকাশ্যে ফিলিস্তিনি সশস্ত্র গোষ্ঠীগুলোর প্রতি সমর্থন জানিয়েছে। এটি ইসরায়েল-ইরান বৈরিতা আরও গভীর করছে এবং সংঘাতকে আঞ্চলিক যুদ্ধে রূপ দিতে পারে। আরব বিশ্বে প্রতিক্রিয়ায় এই হামলার ঘটনায় মিশর, জর্ডান, এবং কাতার এই সংঘাতের বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। যদিও বেশিরভাগ আরব দেশ ইসরায়েলের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে, গাজা পরিস্থিতি সেই প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ইসরায়েলের প্রধান মিত্র হিসেবে সংঘাতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। অন্যদিকে, রাশিয়া ফিলিস্তিনিদের পক্ষে অবস্থান নিয়ে ইসরায়েলের নিন্দা জানিয়ে তার দ্বায়িত্বকে সীমিত রেখেছে।
গাজার বর্তমান সংকট একটি মানবিক বিপর্যয়। জাতিসংঘ, রেড ক্রস এবং বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা এই অঞ্চলে সাহায্য পাঠানোর চেষ্টা করছে। তবে ইসরায়েলি অবরোধের কারণে এই সহায়তা পৌঁছানো অত্যন্ত কঠিন হয়ে পড়ছে।
গাজায় চলমান সংঘাত বিশ্ব মানবতার জন্য একটি কঠিন চ্যালেঞ্জ। এই সংকট শুধু মধ্যপ্রাচ্যের নয়, এটি গোটা বিশ্বের শান্তি, ন্যায়বিচার, ও মানবিকতার জন্য একটি বড় পরীক্ষা। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের উচিত সংঘাতের মূল কারণগুলো চিহ্নিত করে টেকসই সমাধানের পথ বের করা। গাজার মানুষদের এই ভয়াবহ সংকট থেকে মুক্তি দেওয়ার জন্য তাৎক্ষণিক ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া এখন সময়ের দাবি।