জিমি কার্টার, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩৯তম প্রেসিডেন্ট, ১৯২৪ সালের ১ অক্টোবর জর্জিয়ার প্লেইনস শহরে জন্মগ্রহণ করেন। কৃষক পরিবারে বেড়ে ওঠা কার্টার তার কৈশোর থেকেই কর্মঠ, সৎ এবং মানবিক মূল্যবোধের প্রতি শ্রদ্ধাশীল ছিলেন। তিনি ১৯৪৬ সালে ইউ এস নৌবাহিনীতে যোগ দেন এবং পারমাণবিক সাবমেরিন প্রকল্পে কাজ করেন। ১৯৬২ সালে তিনি রাজনীতিতে পা রাখেন এবং ১৯৭১ সালে জর্জিয়ার গভর্নর নির্বাচিত হন।
১৯৭৬ সালে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী হিসেবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেন এবং জেরাল্ড ফোর্ডকে পরাজিত করে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন। তার নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মানবাধিকার রক্ষায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন ঘটে। প্রেসিডেন্ট থাকাকালীন তিনি ক্যাম্প ডেভিড চুক্তি স্বাক্ষর করান, যা মিসর ও ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাত নিরসনে এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ হিসেবে ইতিহাসে স্মরণীয় হয়ে আছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার পর জিমি কার্টারের সময়কালেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক গভীর হয়। ১৯৭৭ থেকে ১৯৮১ সাল পর্যন্ত তার প্রেসিডেন্সি চলাকালে বাংলাদেশে খাদ্য নিরাপত্তা, উন্নয়ন প্রকল্প এবং শিক্ষাক্ষেত্রে সহায়তা প্রদান করা হয়।
বিশেষত, ১৯৭৮ সালে বাংলাদেশে “ফুড ফর পিস” কর্মসূচির আওতায় মার্কিন সরকার প্রচুর খাদ্যশস্য সরবরাহ করে, যা দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় সহায়ক ভূমিকা পালন করে। এই কর্মসূচি বাংলাদেশের কৃষি উৎপাদন বাড়াতে এবং কৃষি খাতের আধুনিকায়নে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
কার্টার সেন্টারের মাধ্যমে বাংলাদেশের নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্য সহায়তা প্রদান ছিল আরও একটি উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ। এই প্রতিষ্ঠানটি পরবর্তী সময়ে বাংলাদেশে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া সুনিশ্চিত করতে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা জোরদার করে।
কার্টার সবসময় মানবাধিকার রক্ষাকে অগ্রাধিকার দিয়েছেন। তার নেতৃত্বে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বিশ্বের বিভিন্ন দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নেয়। ১৯৭৮ সালের ইরান বিপ্লব এবং আফগানিস্তানে সোভিয়েত আগ্রাসনের সময়ে কার্টার প্রভাবশালী ভূমিকা পালন করেন।
তার “কার্টার ডকট্রিন” নীতিমালা মধ্যপ্রাচ্যে মার্কিন তেল স্বার্থ রক্ষায় কার্যকর ভূমিকা রাখে, যা আজও জিওপলিটিক্সে গুরুত্বপূর্ণ।
বাংলাদেশে এই সময়ের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করতে তিনি একাধিকবার পরোক্ষভাবে সমর্থন প্রদান করেন। বিশেষত, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোতে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠায় তার অবদান অনস্বীকার্য।
প্রেসিডেন্সি শেষ করার পর কার্টার নিজেকে মানবাধিকার ও দাতব্য কাজের জন্য উৎসর্গ করেন। ১৯৮২ সালে প্রতিষ্ঠিত “কার্টার সেন্টার” আজও বিশ্বব্যাপী শান্তি প্রতিষ্ঠা ও স্বাস্থ্যসেবায় কাজ করে যাচ্ছে। এই সেন্টার আফ্রিকার নদীকৃতার মতো প্রাণঘাতী রোগ নির্মূলে অনন্য ভূমিকা পালন করেছে।
বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোতেও কার্টার সেন্টারের মাধ্যমে স্বাস্থ্য খাতের উন্নয়ন এবং নির্বাচনী প্রক্রিয়া পর্যবেক্ষণের কাজ হয়েছে। বিশেষত, সুশাসন নিশ্চিত করতে কার্টার সেন্টার যে প্রশিক্ষণ কর্মসূচি পরিচালনা করেছে, তা বাংলাদেশের প্রশাসন ব্যবস্থার জন্য শিক্ষণীয় উদাহরণ হয়ে আছে।
২০২৪ সালের ৩০ ডিসেম্বর, ৯৯ বছর বয়সে কার্টার তার জীবনের শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। তার মৃত্যুতে বিশ্বনেতারা গভীর শোক প্রকাশ করেছেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন থেকে শুরু করে জাতিসংঘের মহাসচিব অ্যান্টোনিও গুতেরেস পর্যন্ত অনেকেই তার মানবিকতা, নেতৃত্ব ও অবদানের প্রশংসা করেছেন।
বাংলাদেশের প্রধানউপদেষ্টা তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছেন এবং তাকে গণতন্ত্র, মানবাধিকার এবং দারিদ্র্য বিমোচনে এক অনন্য ব্যক্তিত্ব হিসেবে উল্লেখ করেছেন।
তার জীবন ও কর্ম থেকে বাংলাদেশের শিখবার অনেক কিছু আছে। বিশেষত, মানবাধিকার রক্ষা, দারিদ্র্য বিমোচন এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় তার নীতি ও উদ্যোগগুলো বাংলাদেশের জন্য শিক্ষণীয়। জিমি কার্টারের জীবন আমাদের মনে করিয়ে দেয়, মানবসেবায় নিবেদিত একজন ব্যক্তি কতটা প্রভাব বিস্তার করতে পারেন। বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের জন্য তার জীবন আদর্শ হতে পারে।
জিমি কার্টার শুধুমাত্র একজন সফল মার্কিন প্রেসিডেন্ট নন, তিনি একজন বিশ্বনেতা, যিনি মানবতার কল্যাণে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন। তার অবদান ইতিহাসের পাতায় চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবে। তার মৃত্যুতে পৃথিবী একজন মহান নেতাকে হারালেও তার শিক্ষা ও আদর্শ আমাদের মাঝে চিরজীবিত থাকবে।