গত ১৪ বছরের অত্যাচারী শাসনের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষের যে নিরলস সংগ্রাম এবং সাহসী প্রতিরোধ, তার চূড়ান্ত প্রকাশ ঘটেছিল ঐতিহাসিক জুলাই-অগাস্ট গণঅভ্যুত্থানে। এই অভ্যুত্থান শুধু একটি সরকারের পতনের কাহিনি নয়; এটি একটি জাতির মুক্তি, স্বপ্ন, এবং গণতান্ত্রিক ভবিষ্যতের জন্য একজোট হওয়ার বিশ্বে অনন্য নজিরবিহীন বিপ্লবের উদাহরণ। এই আন্দোলন রচিত হয়েছে অস্ত্রের বিরুদ্ধে খালি হাতে আর লাল সবুজের জাতীয় পতাকায় মোড়া রক্ত, ঘাম, এবং আত্মত্যাগের অক্ষরে।
অত্যাচারী শাসনের কালো অধ্যায়
১৪ বছরের শাসনামলে দেশের মানুষ দুর্নীতি, দুঃশাসন, এবং দমন-পীড়নের শিকার হয়েছে। গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ, বিরোধী মত দমনে গুম-খুনের রাজনীতি, এবং সাধারণ মানুষের মৌলিক অধিকার খর্ব করে একটি শোষণমূলক ব্যবস্থার সূচনা হয়। অর্থনৈতিক বৈষম্য বাড়তে থাকে, এবং ক্ষমতাসীনরা নিজেদের স্বার্থে দেশের সম্পদ লুণ্ঠন করে। এসবের মধ্যে, সবচেয়ে বড় আঘাত পড়ে দেশের ছাত্র সমাজের উপর।
বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে হামলা, ছাত্রদের উপর দমন-পীড়ন, এবং তাদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়া হয়। কিন্তু জাতির সবচেয়ে সজীব ও সাহসী শক্তি হিসেবে ছাত্র সমাজ চুপ করে থাকেনি। তারা নিজেদের রক্ত দিয়ে একটি নতুন ভবিষ্যৎ গড়ার শপথ নেয়।

জুলাই–অগাস্ট অভ্যুত্থানের সূচনা
২০২৪ সালের জুলাই মাসে শুরু হয় এক ঐতিহাসিক আন্দোলনের। একটি ছোট্ট ছাত্র সমাবেশ থেকে শুরু হওয়া এই গণজোয়ার অল্প কয়েক দিনের মধ্যেই সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে। ছাত্ররা শুধু তাদের অধিকার আদায়ের জন্য নয়, বরং গোটা জাতিকে একত্রিত করে শাসকের অন্যায়ের বিরুদ্ধে দাঁড়াতে উদ্বুদ্ধ করে। ঢাকার শাহবাগ, চট্টগ্রামের লালদিঘি মাঠ, এবং রাজশাহী ও সিলেটের ময়দানে লাখ লাখ মানুষ জড়ো হতে থাকে।
শহীদের আত্মত্যাগ: একেকটি রাত ছিল রক্তাক্ত। শাসকের লেলিয়ে দেওয়া বাহিনীর গুলিতে প্রাণ হারায় অনেক সাহসী তরুণ। রংপুরের বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র আবু সাঈদের পুলিশের গুলিতে আত্মত্যাগ সকল শ্রেণীপেশার মানুষের মাঝে আন্দোলনের বীজ বপন করে। ঢাকার শাহবাগে ২২ বছর বয়সী সাদিয়া রহমানের মৃত্যু আন্দোলনকারীদের মধ্যে আগুন ছড়িয়ে দেয়। তার হাতে ধরা ছিল একটি প্ল্যাকার্ড, যেখানে লেখা ছিল: “আমাদের স্বপ্ন ছিনিয়ে নেবে না।” এই ছবি সারা দেশে বিদ্রোহের প্রতীক হয়ে ওঠে। চট্টগ্রামের রাজপথে প্রাণ হারায় সীতাকুণ্ডের কৃষকের সন্তান ইমরান। তার মা বলেন, “আমার ছেলে দেশের জন্য জীবন দিয়েছে। এই শাসকের পতন না হওয়া পর্যন্ত আমি শান্ত হব না।”

গণঅভ্যুত্থানের রূপ
অগাস্ট মাসে আন্দোলন আরও তীব্র হয়ে ওঠে। সাধারণ মানুষ, কৃষক, শ্রমিক, এবং পেশাজীবীরা খালি হাতে রাস্তায় নামতে শুরু করে। শহিদ মীর মুগ্ধেরা পানি হাতে এগিয়ে আসে আন্দোলনের সহমর্মিতায়। এই অভ্যুত্থানে দেশের প্রতিটি স্তরের মানুষের অংশগ্রহণ প্রমাণ করে, এটি কেবল একটি রাজনৈতিক আন্দোলন নয়; এটি একটি জাতীয় জাগরণ।
অভ্যুত্থানের নেতৃত্ব দেয় ছাত্র সমাজ, তবে এর পেছনে ছিল সুশীল সমাজ এবং বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের সক্রিয় সমর্থন। এ সময় আন্দোলনের তিনটি মুখ্য দাবিতে সবাই একমত হয়েছিল:
১. অবিলম্বে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা। ২. নিপীড়নমূলক আইন বাতিল। ৩. দুর্নীতিবাজ এবং গুম-খুনে জড়িতদের বিচারের আওতায় আনা।
আত্মত্যাগ ও সাহসের ইতিহাস
এই গণঅভ্যুত্থান স্মরণ করিয়ে দেয় অতীতের সংগ্রামের কথা। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ—প্রতিটি লড়াইয়ে ছাত্র এবং সাধারণ মানুষই সামনের সারিতে ছিল। ১৯৮৭ সালের ছাত্র আন্দোলনের সময় যেমন সেলিম-দেলোয়ারের আত্মত্যাগ এক নতুন ইতিহাস লিখেছিল, তেমনি ২০২৪ সালের আন্দোলনে সাঈদ, সাদিয়া, ইমরান এবং আরও অসংখ্য তরুণ নতুন প্রজন্মের জন্য এক উদাহরণ সৃষ্টি করেছে।
শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভূমিকা: বিশ্ববিদ্যালয়গুলো আবারও প্রমাণ করে যে, তারা কেবল শিক্ষার কেন্দ্র নয়, বরং জাতির চেতনার আঁতুরঘর। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়, এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা এই আন্দোলনের মূল শক্তি ছিল।

জয়ের পথে জাতি
অবশেষে, অগাস্টের ৫ তারিখে লাখো কোটি জনতার একত্রীকৃত শক্তির মুখে শাসকগোষ্ঠী নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়। দেশের বরেন্য ব্যাক্তি পেশাজীবি ও ছাত্রদের সমন্বয়ে একটি নজিরবিহীন ইতিহাসগড়া অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হয়। পুলিশ, বিচারালয়, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সকল ক্ষেত্র হতেই প্রশাসনের সকল স্তরেই দুর্নীতিপরায়ন অত্যাচারীরা একযোগে পালিয়ে যায় যা ইতিহাসে বিড়ল। সশস্ত্রবাহীনি তার অতীত ভুল শুধরে দেশ ও জাতির স্বার্থে পাশে এসে দাড়ায় তাদের দ্বায়িত্ববোধ থেকেই। শাসকের পতন কোনো ব্যক্তিগত বিজয় নয়, এটি গোটা জাতির বিজয়।
নতুন বছরের নতুন প্রত্যয়
২০২৫ সালে আমরা প্রবেশ করছি নতুন স্বপ্ন নিয়ে। এই বছর আমাদের জন্য হবে গণতন্ত্র, সাম্য, এবং উন্নয়নের বছর। আমাদের প্রত্যয়:
১. গণতন্ত্র রক্ষা: আমরা যেন আর কখনো শাসকের দমন-পীড়নের শিকার না হই। ২. শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা: দেশের প্রতিটি মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। ৩. যুবসমাজের উন্নয়ন: ছাত্রদের আত্মত্যাগ যেন বৃথা না যায়। তাদের জন্য কর্মসংস্থান এবং সৃজনশীলতার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে।
শেষ কথা
জুলাই-অগাস্টের অভ্যুত্থান আমাদের শিখিয়েছে যে, ঐক্যের শক্তি অপ্রতিরোধ্য। দেশের মানুষ যখন একত্রিত হয়, তখন কোনো শাসকই তাদের দাবিয়ে রাখতে পারে না। যারা এই আন্দোলনে প্রাণ দিয়েছেন, তাদের আত্মত্যাগ যেন আমাদের ভবিষ্যৎ নির্মাণের প্রতিটি ধাপে প্রেরণা হয়ে থাকে।
নতুন বছর আমাদের জন্য একটি নতুন অধ্যায়। চলুন, সবাই মিলে যার যার যায়গা থেকে সৎ হয়ে একটি সুন্দর, সমৃদ্ধ, এবং গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ গড়ে তুলি।