টেলিযোগাযোগ খাত একটি রাষ্ট্রের যোগাযোগব্যবস্থার মেরুদণ্ড হিসেবে কাজ করে। কিন্তু বাংলাদেশে এই খাতটি বারবার দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারের শিকার হয়েছে। সম্প্রতি, বিটিআরসির (বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন) একটি আইজিডব্লিউ (ইন্টারন্যাশনাল গেটওয়ে) কোম্পানি ‘কে টেলিকম’-এর মালিকানা এবং সংশ্লিষ্ট পাওনা আদায় নিয়ে ওঠা বিতর্ক এবং শামীম ওসমান পরিবারের সংশ্লিষ্টতা এই খাতের দুর্নীতির চিত্র আরও স্পষ্ট করেছে।
‘কে টেলিকম’ নামক আইজিডব্লিউ প্রতিষ্ঠানের মূল মালিক ছিলেন নারায়ণগঞ্জের প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা শামীম ওসমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যরা। ২০১২ সালে সরকার থেকে এই প্রতিষ্ঠানের জন্য ১৫ বছরের লাইসেন্স নেওয়া হয়। তবে লাইসেন্স নেওয়ার পর প্রতিষ্ঠানটির মাধ্যমে বিদেশ থেকে টেলিফোন কল আনার আয় থেকে সরকারের ন্যায্য পাওনা আদায় করা হয়নি।
বিটিআরসির নথি অনুযায়ী, কে টেলিকমের কাছে সরকারের পাওনা ১২৬ কোটি টাকারও বেশি। ২০১৪ সালে বিটিআরসি পাওনা আদায়ে মামলা করলেও মালিকানা পরিবর্তনের একটি কারসাজির মাধ্যমে প্রতিষ্ঠানটি নতুন মালিকদের নামে স্থানান্তরিত হয়। মালিকানা পরিবর্তনের সময় বিটিআরসি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকে প্রয়োজনীয় যাচাই-বাছাই করা হয়নি, যা দুর্নীতির অন্যতম প্রমাণ।
বিটিআরসির দেওয়া তথ্যমতে, কে টেলিকমের মালিকানা ২০১৩ সালের ৪ আগস্ট তিনজন ব্যক্তির নামে স্থানান্তর করা হয় – সাখাওয়াত হোসেন, সিলেটের স্কুলশিক্ষক দেবব্রত চৌধুরী এবং বগুড়ার অফিস সহকারী রাকিবুল ইসলাম। কিন্তু এই তিনজনই বাংলাদেশের গনমাধ্যমের অনুসন্ধানে নিশ্চিত করেছেন যে, তাঁরা কখনো এই প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না। তাঁদের জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) জালিয়াতি করে এই মালিকানা পরিবর্তন করা হয়েছে।
সাখাওয়াত হোসেন ফকিরাপুলে একটি ছোট্ট ট্রাভেল এজেন্সি চালান, যার অফিস ভাড়া মাত্র ছয় হাজার টাকা। তিনি জানান, বিটিআরসি ও পুলিশ প্রথম তাঁর গ্রামের বাড়িতে গিয়ে তাঁকে মালিকানা সম্পর্কে জানান। তিনি কখনো “কে টেলিকমের” নামও শোনেননি। দেবব্রত চৌধুরী, যিনি সিলেটের একজন স্কুলশিক্ষক, তাঁকে পর্যন্ত পুলিশ গ্রেপ্তার করে। তিনি জানান, এ ঘটনায় তাঁর সামাজিক মর্যাদার ক্ষতি হয়েছে। অন্যদিকে, রাকিবুল ইসলাম বলেন, তাঁর এনআইডি চুরি করে জালিয়াতির মাধ্যমে তাঁর নামে মালিকানা স্থানাস্তর করা হয়েছে।
কে টেলিকমের মালিকানা স্থানান্তর করার পেছনে শামীম ওসমান এবং তাঁর পরিবারের সদস্যদের রাজনৈতিক প্রভাব ও ক্ষমতার অপব্যবহারের অভিযোগ উঠে এসেছে। তৎকালিন সরকারের পত্যক্ষ ও পরোক্ষ প্রভাবে বিটিআরসি ও সংশ্লিষ্ট সংস্থাগুলোও তাদের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয়েছে। বিটিআরসি দাবি করেছে যে, মালিকানা স্থানান্তর যথাযথ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে করা হয়েছে। কিন্তু বিটিআরসির একটি সূত্র ও সরকারী তদন্ত সংস্থা বলছে, “কে টেলিকমের” মালিকানা পরিবর্তনের আবেদন যাচাই না করেই অনুমোদন দেওয়া হয়। এতে ভুয়া ছবি ও জাল নথি ব্যবহৃত হয়েছে।
টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জামান বলেছেন, এই ঘটনায় বহুমাত্রিক দুর্নীতি হয়েছে। ওসমান পরিবার ক্ষমতার অপব্যবহার করে রাষ্ট্রের বিশাল অর্থ বঞ্চিত করেছে। এমনকি নিরীহ ব্যক্তিদের ওপর দায় চাপিয়ে তাঁদের সামাজিক ও আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। এই দুর্নীতি সরাসরি রাষ্ট্রের রাজস্ব খাতে বিশাল ক্ষতি করেছে। পাওনা ১২৬ কোটি টাকা আদায় না হওয়ায় রাষ্ট্রের অর্থনৈতিক উন্নয়নের পথে বাধা সৃষ্টি হয়েছে। পাশাপাশি জালিয়াতির শিকার ব্যক্তিরা যেমন দেবব্রত চৌধুরী এবং রাকিবুল ইসলাম চরম সামাজিক লজ্জা ও হয়রানির শিকার হয়েছেন। এ ধরনের ঘটনা সাধারণ মানুষের রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের প্রতি আস্থাহীনতা বাড়িয়ে দেয়।
এই ঘটনায় সংশ্লিষ্ট সবার বিরুদ্ধে নিরপেক্ষ তদন্ত চালিয়ে তাঁদের জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে। দ্রুততর সময়ের মধ্যে বিটিআরসির দ্বারা মালিকানা জালিয়াতি এবং পাওনা আদায়ে গাফিলতির সঙ্গে জড়িত ব্যক্তি ও সংস্থার বিরুদ্ধে আইনি পদক্ষেপ নিতে হবে এবং সর্বোচ্চ মহল হতে সকল অভিযুক্তদের এই সময়ে তাদের চাকুরী থেকে সাময়িক অব্যহতি প্রদান করে বিচারের ক্ষেত্রে তাদের সংশ্লিষ্টতার সুযোগ বন্ধ করতে হবে। এনআইডি ব্যবহারে সুরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য উন্নত প্রযুক্তি ও বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ করতে হবে। রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করতে হবে।
”কে টেলিকমের” মালিকানা বিতর্ক এবং শামীম ওসমান পরিবারের দুর্নীতি একটি রাষ্ট্রের জন্য বিরাট সতর্কবার্তা। এ ধরনের ঘটনা শুধু অর্থনৈতিক ক্ষতি নয়, সামাজিক আস্থার সংকটও তৈরি করে। রাষ্ট্রের প্রতি মানুষের বিশ্বাস ধরে রাখতে দ্রুত ও কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া জরুরি। এটি সম্ভব হলে দুর্নীতির মাধ্যমে রাষ্ট্রীয় সম্পদের অপচয় রোধ করা যাবে এবং একটি স্বচ্ছ প্রশাসনিক কাঠামো গড়ে তোলা সম্ভব হবে।