বিমানের টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি: অর্থনৈতিক প্রভাব ও জনজীবনের গুরুত্ব

বিমানের টিকিটের মূল্য বৃদ্ধি: অর্থনৈতিক প্রভাব ও জনজীবনের গুরুত্ব

0
26
বিমানের টিকেটের দাম বাড়লো

আকাশপথে ভ্রমণের জন্য উড়োজাহাজের টিকিটের মূল্যবৃদ্ধি বর্তমানে একটি আলোচিত বিষয়। জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) কর্তৃক আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি এই মূল্যবৃদ্ধির মূল কারণ হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক রুটে এই শুল্ক বৃদ্ধির প্রভাব বিমানের অপারেটর, যাত্রী, এবং সামগ্রিকভাবে দেশের অর্থনীতিতে স্পষ্টভাবে পড়ছে।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক ফ্লাইটের উপর আবগারি শুল্ক বৃদ্ধি করেছে। অভ্যন্তরীণ রুটে শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে বাড়িয়ে ৭০০ টাকা করা হয়েছে, যা ৪০% বৃদ্ধি নির্দেশ করে। সার্কভুক্ত দেশগুলোর ক্ষেত্রে এই শুল্ক ৫০০ টাকা থেকে ১,০০০ টাকা করা হয়েছে। এশিয়ার অন্যান্য দেশের জন্য শুল্ক ২,০০০ টাকা থেকে বেড়ে আড়াই হাজার টাকা হয়েছে। ইউরোপ ও আমেরিকার ক্ষেত্রে শুল্ক বৃদ্ধি হয়েছে ১,০০০ টাকা, যা এখন মোট ৪,০০০ টাকায় দাঁড়িয়েছে।

এই বৃদ্ধির ফলে অভ্যন্তরীণ ফ্লাইটের ক্ষেত্রে একজন যাত্রীর টিকিটে শুল্ক-কর প্রায় ১,১৭৫ টাকায় পৌঁছেছে। আন্তর্জাতিক রুটে, বিশেষ করে সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, এবং মালয়েশিয়ার ক্ষেত্রে, প্রতিটি টিকিটে শুল্ক-কর ৫০০ টাকা বৃদ্ধি পেয়েছে।

মূল্যবৃদ্ধির প্রতিক্রিয়া হিসাবে যেটা পরিলক্ষিত হয়েছে তা হল; আকাশপথে যাতায়াত এখন আর বিলাসী সেবা নয়। এটি একাধিক উদ্দেশ্যে ব্যবহৃত একটি প্রয়োজনীয় সেবা হয়ে উঠেছে। তবে এই মূল্যবৃদ্ধি সাধারণ যাত্রী থেকে শুরু করে বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো পর্যন্ত সবার জন্যই একটি চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।

ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের মহাব্যবস্থাপক মো. কামরুল ইসলাম জানান, শুল্ক বৃদ্ধি বিমানের কার্যক্রম এবং যাত্রীদের উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে। পর্যটনের ভরা মৌসুমে এই প্রভাব কম টের পেলেও অফ-সিজনে এর গুরুতর প্রভাব দেখা দেবে।

এয়ার অ্যাস্ট্রার প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ইমরান আসিফ উল্লেখ করেন, বছরের মাঝপথে এমন শুল্ক বৃদ্ধি বিমান সংস্থাগুলোর জন্য গভীর সমস্যার সৃষ্টি করবে। এটি বিশেষত বেসরকারি সংস্থাগুলোর ব্যবসায় একটি বড় ধাক্কা। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে দেশের অর্থনীতি এবং ব্যবসায়িক পরিবেশে যে প্রভাব পড়তে পারে, তা উল্লেখযোগ্য।

শীতের মৌসুমে পর্যটনের চাহিদা বৃদ্ধি পায়। এই সময়ে ভারত, নেপাল, থাইল্যান্ড, এবং মালয়েশিয়ার মতো গন্তব্যে ভ্রমণকারীদের সংখ্যা বেশি থাকে। কিন্তু শুল্ক বৃদ্ধির ফলে এই ভ্রমণের খরচ বেড়ে যাওয়ায় পর্যটকদের মধ্যে নিরুৎসাহ দেখা দিচ্ছে।

আকাশপথে ভ্রমণ অনেক ব্যবসায়িক কাজে অত্যাবশ্যক। শুল্ক বৃদ্ধির কারণে ব্যবসায়ীদের খরচ বাড়ছে, যা দীর্ঘমেয়াদে তাদের কার্যক্রমে প্রভাব ফেলতে পারে। বিশেষত ছোট ও মাঝারি ব্যবসায়ীরা এ খরচ বহনে বেশি সমস্যার মুখে পড়বেন।

একটি চার সদস্যের পরিবার যদি থাইল্যান্ড ভ্রমণ করে, তবে তাদের নতুন শুল্ক কাঠামোর কারণে অতিরিক্ত ২,০০০ টাকা শুল্ক দিতে হবে। এই ধরনের খরচ বাড়তি চাপ সৃষ্টি করে, বিশেষত মধ্যবিত্ত পরিবারের জন্য।

বেসরকারি বিমান সংস্থাগুলো যেমন নভোএয়ার, ইউএস-বাংলা, এবং এয়ার অ্যাস্ট্রার মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর আয় মূলত অভ্যন্তরীণ এবং কাছাকাছি আন্তর্জাতিক গন্তব্যে নির্ভরশীল। শুল্ক বৃদ্ধি তাদের প্রতিযোগিতা ক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে। এছাড়া পর্যটন ভিসা সীমিত হওয়া এবং ডলারের উচ্চ মূল্যের কারণে তাদের আয় আরও কমেছে।

দৈনন্দিন জনজীবনে প্রভাব হিসাবে যা পরিলক্ষিত হচ্ছে তা হল; আকাশপথে যাতায়াত শুধুমাত্র একটি পরিবহন মাধ্যম নয়; এটি দ্রুত এবং কার্যকর যাতায়াতের জন্য অপরিহার্য। শুল্ক বৃদ্ধির ফলে বিভিন্ন শ্রেণির মানুষের উপর যে প্রভাব পড়ছে তা নিম্নরূপ:

ব্যবসায়ী ও পেশাজীবী যারা রয়েছেন, শুল্ক বৃদ্ধি তাদের ভ্রমণ খরচ বাড়িয়ে দিয়েছে। বিশেষত যাঁরা নিয়মিতভাবে আন্তর্জাতিক ভ্রমণ করেন, তাঁদের ক্ষেত্রে এটি একটি বড় আর্থিক চাপ সৃষ্টি করছে।

চিকিৎসার জন্য ভ্রমণকারী অনেক রোগী উন্নত চিকিৎসার জন্য বিদেশে যান। নতুন শুল্ক কাঠামোয় তাদের খরচ বেড়ে যাওয়ায় চিকিৎসার জন্য প্রয়োজনীয় ভ্রমণে বাধা সৃষ্টি হতে পারে।

শিক্ষার্থী এবং অভিবাসীদের জন্য এই খরচ বাড়তি বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিদেশে পড়তে যাওয়া বা কর্মসূত্রে যাঁরা যান, তাঁদের পরিবারকে বাড়তি অর্থের যোগান দিতে হচ্ছে।

অভ্যন্তরীণ এবং আন্তর্জাতিক পর্যটকদের সংখ্যা কমে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, যা পর্যটন খাতে নেতিবাচক প্রভাব ফেলবে।

বিমান টিকিটের শুল্ক বৃদ্ধি একটি নীতিগত পরিবর্তন হলেও, এর নেতিবাচক প্রভাব কমাতে কিছু পদক্ষেপ গ্রহণ করা যেতে পারে।

ব্যবসায় এবং যাত্রীদের প্রস্তুতির জন্য শুল্ক বৃদ্ধি ধাপে ধাপে কার্যকর করা যেতে পারে।

নির্দিষ্ট ক্যাটাগরির জন্য যেমন; শিক্ষার্থী, রোগী, এবং ব্যবসায়িক যাত্রীদের জন্য বিশেষ শুল্ক রেয়াতের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

স্থানীয় বিমান সংস্থাগুলোর জন্য প্রণোদনার আলাদা নীতির মাধ্যমে স্থানীয় এয়ারলাইনসগুলোর প্রতিযোগিতা ক্ষমতা ধরে রাখতে কর রেয়াত বা ভর্তুকি দেওয়া যেতে পারে।

শুল্ক কাঠামোর পুনর্মূল্যায়ন করে শুল্ক বৃদ্ধি থেকে প্রাপ্ত রাজস্বের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত করতে একটি স্বচ্ছ এবং কার্যকর কাঠামো তৈরি করা জরুরি।

পর্যটন খাতের উন্নয়নের স্বার্থে দেশীয় পর্যটন শিল্পকে আরও শক্তিশালী করতে বিশেষ প্রণোদনা এবং প্রচারণা কার্যক্রম গ্রহণ করা যেতে পারে। আকাশপথে ভ্রমণের জন্য শুল্ক বৃদ্ধি একটি বিতর্কিত সিদ্ধান্ত, যা একদিকে সরকারের রাজস্ব বৃদ্ধির লক্ষ্যে কার্যকর হতে পারে, অন্যদিকে সাধারণ মানুষের জন্য আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে। এই মূল্যবৃদ্ধির অর্থনৈতিক ও সামাজিক প্রভাব দীর্ঘমেয়াদে আরও স্পষ্ট হবে। শুল্ক কাঠামোর পরিবর্তন এমনভাবে পরিচালিত হওয়া উচিত, যা জনগণের উপর নেতিবাচক প্রভাব কমিয়ে আনতে পারে এবং দেশের বিমান পরিবহন খাতকে স্থিতিশীল রাখতে পারে।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here