সংবিধান সংস্কার কমিশন দেশের রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক কাঠামোতে আমূল পরিবর্তনের একটি প্রস্তাব চূড়ান্ত করেছে, যা আগামীকাল অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের কাছে জমা দেওয়া হবে। এই প্রস্তাব অনুযায়ী, জাতীয় সংসদকে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট করার সুপারিশ করা হয়েছে। নতুন কাঠামোয় সংসদের নিম্নকক্ষে আসন সংখ্যা থাকবে ৪০০ এবং উচ্চকক্ষে ১০৫টি।
নিম্নকক্ষের নির্বাচন পদ্ধতি
নিম্নকক্ষের ৪০০টি আসনে নির্বাচন হবে বর্তমান পদ্ধতিতে। এর মধ্যে ১০০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত থাকবে। সংরক্ষিত এই আসনগুলোতে নারীরা সরাসরি ভোটে নির্বাচিত হবেন। বর্তমানে নারীদের জন্য সংরক্ষিত আসনগুলো সাধারণ নির্বাচন শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর আসনসংখ্যার অনুপাতে বণ্টিত হয়।
উচ্চকক্ষের কাঠামো ও নির্বাচন পদ্ধতি
প্রস্তাবিত উচ্চকক্ষে আসন থাকবে ১০৫টি। এর মধ্যে ৫টি আসনে রাষ্ট্রপতি বিশেষ মনোনয়ন দেবেন, যা সমাজের পিছিয়ে পড়া অংশগুলোর প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করবে। বাকি ১০০টি আসনে আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব পদ্ধতিতে নির্বাচন হবে। দলগুলো সারাদেশে যত ভোট পাবে, তার ভিত্তিতে উচ্চকক্ষে আসন বণ্টন করা হবে। এছাড়া দলগুলোর উচ্চকক্ষের প্রার্থী মনোনয়নের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অংশের প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করার বাধ্যবাধকতা থাকবে।
দ্বিকক্ষ সংসদের প্রস্তাবের ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট
স্বাধীনতার পর থেকে বাংলাদেশে এককক্ষবিশিষ্ট সংসদ চালু রয়েছে। সংবিধানের বিদ্যমান কাঠামোয় সংসদের মোট আসন সংখ্যা ৩৫০, যার মধ্যে ৫০টি আসন নারীদের জন্য সংরক্ষিত। বিএনপিসহ বেশ কয়েকটি রাজনৈতিক দল এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি দীর্ঘদিন ধরে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদের প্রস্তাব করে আসছে।
ক্ষমতার ভারসাম্য আনার লক্ষ্য
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ক্ষমতার কেন্দ্রীকরণ রোধ এবং সাংবিধানিক একনায়কতন্ত্র ঠেকানোর লক্ষ্যে এই সংস্কারগুলি প্রস্তাবিত। প্রস্তাবে উল্লেখিত প্রধান সুপারিশগুলোর মধ্যে রয়েছে:
- দ্বিকক্ষবিশিষ্ট সংসদ: ক্ষমতার বিকেন্দ্রীকরণের জন্য এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ।
- প্রধানমন্ত্রীর মেয়াদ নির্ধারণ: একজন ব্যক্তি সর্বোচ্চ কয়টি মেয়াদে প্রধানমন্ত্রী হতে পারবেন, তা নির্ধারণ করা।
- নির্বাহী বিভাগের জবাবদিহি: নির্বাহী বিভাগের কর্মকাণ্ডে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করা।
- নির্বাচনকালীন অন্তর্বর্তী সরকার: নির্বাচন পরিচালনার জন্য নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিধান।
- ক্ষমতার ভারসাম্য: প্রধানমন্ত্রী ও রাষ্ট্রপতির মধ্যে ক্ষমতার ভারসাম্য আনা।
- বিচার বিভাগের স্বাধীনতা: বিচার বিভাগের কার্যক্রমকে নির্বাহী বিভাগের হস্তক্ষেপ থেকে মুক্ত রাখা।
- সংবিধানের মূলনীতি পরিবর্তন: সংবিধানের মূলনীতিতে ‘সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার’ যুক্ত করার প্রস্তাব।
নির্বাচনব্যবস্থার সংস্কার
নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের প্রস্তাব অনুযায়ী, দীর্ঘ মেয়াদে অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন নিশ্চিত করার লক্ষ্যে বেশ কিছু সুপারিশ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে:
- নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার জন্য আইন সংশোধন।
- নির্বাচন কমিশনের ওপর নির্বাচনের সময় যুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলোর নিয়ন্ত্রণ নিশ্চিত করা।
- প্রধান নির্বাচন কমিশনার ও কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া সংস্কার।
- প্রার্থীর হলফনামায় বিদেশে সম্পদের বিবরণ দেওয়া বাধ্যতামূলক করা।
- ‘না’ ভোটের বিধান যুক্ত করা।
- সংরক্ষিত নারী আসনে সরাসরি ভোটের ব্যবস্থা।
- রাজনৈতিক দলের প্রার্থী মনোনয়ন পদ্ধতিতে পরিবর্তন।
দুর্নীতি দমন কমিশনের সংস্কার
দুদক সংস্কার কমিশন প্রস্তাব করেছে, দুদকের চেয়ারম্যান ও কমিশনারদের নিয়োগ প্রক্রিয়া দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখা। তারা একটি স্বচ্ছ ও যোগ্যতাভিত্তিক নিয়োগ প্রক্রিয়া প্রবর্তনের সুপারিশ করেছে। এছাড়া, কর্মকর্তাদের ন্যায্য সুযোগ-সুবিধা নিশ্চিত করা এবং দুর্নীতির অভিযোগ যাচাই-বাছাই প্রক্রিয়া আধুনিকায়নের কথা বলা হয়েছে।
প্রতিবেদন জমা ও পরবর্তী পদক্ষেপ
সংবিধান সংস্কার কমিশনসহ ছয়টি সংস্কার কমিশনের প্রতিবেদন আগামীকাল অন্তর্বর্তী সরকারের কাছে জমা দেওয়া হবে। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপের মাধ্যমে প্রস্তাবগুলোর বাস্তবায়ন নিয়ে আলোচনা শুরু হবে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা আশা করছেন, এই প্রক্রিয়া থেকে একটি কার্যকর রূপরেখা বেরিয়ে আসবে। তবে রাজনৈতিক মতপার্থক্য দূর করা এবং ঐকমত্য তৈরি করাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ।
রাজনৈতিক ও সামাজিক প্রতিক্রিয়া
সংবিধান সংস্কার কমিশনের প্রস্তাবগুলোকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক সংগঠন এবং বিশ্লেষকদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা দিয়েছে। বিএনপি ও জাতীয় নাগরিক কমিটি দ্বিকক্ষ সংসদের প্রস্তাবকে ইতিবাচকভাবে দেখছে। অন্যদিকে, রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করছেন, এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়ন হলে দেশে গণতন্ত্রের প্রাতিষ্ঠানিক রূপ আরও দৃঢ় হবে।
সংবিধান ও সংসদের কাঠামোতে এই পরিবর্তনগুলো বাংলাদেশে ক্ষমতার ভারসাম্য আনার পাশাপাশি গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাকে আরও সুদৃঢ় করবে। তবে, রাজনৈতিক ঐকমত্য এবং কার্যকর বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া নিশ্চিত করাই এখন সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।