বর্তমান বিশ্বের অন্যতম চ্যালেঞ্জ হিসেবে বায়ুদূষণ যেন একটি সাধারন বিষয় হয়ে দাড়িয়েছে। আর ঢাকার বায়ু পৃথিবীর সবচেয়ে দূষিত হিসেবে চিহ্নিত হওয়ায়, আমাদের পরিবেশগত সংকটের ভয়াবহ চিত্রটি তুলে ধরে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা এবং গবেষণা প্রতিষ্ঠানের জরিপ ও তাদের প্রকাশিত ফলাফল আমাদের কাছে এই বাস্তবতাটি উন্মোচন করে। কিন্তু এ সমস্যার সমাধান শুধুমাত্র প্রশাসনিক উদ্যোগ নয়, বরং আমাদের প্রত্যেকের যৌথ প্রচেষ্টার ফলস্বরূপ আসতে পারে।চলুন দেখা যাক ঢাকার বায়ুদূষণের বর্তমান চিত্র। ঢাকার বায়ুর মান বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO)-র নির্ধারিত সীমার চেয়ে বহুগুণ বেশি খারাপ। ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে আইকিউএয়ার (IQAir)-এর প্রকাশিত “ওয়ার্ল্ড এয়ার কোয়ালিটি রিপোর্ট” অনুযায়ী, ঢাকা বিশ্বের দূষিত শহরগুলোর তালিকার শীর্ষে রয়েছে।বায়ুদূষণের সূচক একটি মাত্রা যা বায়ুদূষণ নির্ধারণে “এয়ার কোয়ালিটি ইনডেক্স” (AQI)-এর ব্যবহার সর্বাধিক প্রচলিত। AQI-এর মান যদি ৫০-এর নিচে থাকে, তবে তা স্বাস্থ্যসম্মত ধরা হয়। ঢাকার AQI প্রায়শই ২০০-৩০০ এর মধ্যে অবস্থান করে, যা “খুবই অস্বাস্থ্যকর” স্তর নির্দেশ করে। কোন কোন সময় এই মান ৪০০-ও ছাড়িয়ে যায়, যা “বিপজ্জনক” স্তরের সমান।
- ঢাকার আশেপাশে অবস্থিত হাজার হাজার ইটভাটা, যেগুলোতে জ্বালানি হিসেবে নিম্নমানের কয়লা ও কাঠ ব্যবহার করা হয়।পুরনো এবং অননুমোদিত যানবাহনের অতিরিক্ত ধোঁয়া ঢাকার বাতাসের একটি বড় দূষণ উৎস।অনিয়ন্ত্রিত নির্মাণকাজ এবং সঠিক ব্যবস্থাপনার অভাবে উৎপন্ন ধুলিকণা।বর্জ্য পোড়ানো এবং খোলা জায়গায় আবর্জনা ফেলার ফলে বায়ুতে ক্ষতিকারক গ্যাস নির্গত হয়।বায়ুদূষণের কারণে মানুষের স্বাস্থ্যে দীর্ঘমেয়াদী ও স্বল্পমেয়াদী প্রভাব পড়ছে।শ্বাসযন্ত্রের রোগ: হাঁপানি, ব্রংকাইটিস এবং ক্রনিক অবস্ট্রাকটিভ পালমোনারি ডিজিজ (COPD)।হৃদরোগ: দূষিত বায়ু রক্তনালীর উপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে, যা হৃদরোগের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে।ক্যান্সার: বায়ুদূষণে উপস্থিত ক্ষতিকারক রাসায়নিক কণা ফুসফুস ক্যান্সারের কারণ হতে পারে।চোখে জ্বালা এবং পানি পড়া।মাথা ঘোরা এবং শ্বাসকষ্ট।শিশুদের এবং বয়স্কদের জন্য বিশেষত ঝুঁকিপূর্ণ।
সমস্যার মূল কারণগুলো একটু দেখা যাক; ১. নীতির অভাব: পরিবেশগত নীতি প্রণয়ন ও বাস্তবায়নে ঘাটতি। ২. অপরিকল্পিত নগরায়ন: ঢাকার দ্রুত নগরায়নের সাথে প্রয়োজনীয় পরিবেশ সুরক্ষা ব্যবস্থা অনুসরণ করা হয়নি। ৩. সচেতনতার অভাব: জনগণের মাঝে পরিবেশ সচেতনতার অভাব।সমাধানে শিক্ষার্থী ও পরিবেশবাদীদের ভূমিকা সবার আগে, এই ভুমিকা অত্যস্ত গুরুত্বপূর্ণ। কেননা তাদেরকেই সকলে অনুসরন করে। প্রথমত সচেতনতা বৃদ্ধি, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিবেশ সচেতনতা বিষয়ক কর্মসূচি চালু করা উচিত। শিক্ষার্থীরা পরিবেশ রক্ষার বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করতে পারে এবং সাধারণ মানুষকে সচেতন করতে পারে। যে বিষয়গুলো নিয়ে নিয়মিত আলোচনা হতে পারে তা হল; প্রাত্যহিক আচরণ পরিবর্তন
পুনর্ব্যবহারযোগ্য পণ্য ব্যবহার: প্লাস্টিকের বদলে পুনর্ব্যবহারযোগ্য জিনিস ব্যবহার করা। পরিবেশবান্ধব যানবাহন: সাইকেল বা পাবলিক ট্রান্সপোর্ট ব্যবহারের অভ্যাস তৈরি করা। গাছ লাগানো: বেশি বেশি গাছ লাগিয়ে শহরের সবুজায়ন বাড়ানো।
এবং পরবর্তি পদক্ষেপ হিসাবে নীতিমালা প্রভাবিত করা;পরিবেশবাদীরা সরকার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর কাছে সুনির্দিষ্ট দাবিনামা পেশ করতে পারে। তারা দূষণ নিয়ন্ত্রণে কার্যকর আইন বাস্তবায়নের জন্য চাপ সৃষ্টি করতে পারে।আন্তর্জাতিক উদ্যোগ ও অনুপ্রেরণাবিশ্বের অন্যান্য শহর বায়ুদূষণ মোকাবিলায় যে পদক্ষেপ নিয়েছে, সেগুলো আমাদের জন্য উদাহরণ হতে পারে। যেমন:বেইজিং মডেল: চীনের রাজধানী বেইজিং, এক সময় দূষিত শহরগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল। কঠোর আইন, প্রযুক্তি ব্যবহার, এবং প্রচারণার মাধ্যমে তারা বায়ুর মান উল্লেখযোগ্যভাবে উন্নত করেছে।ইউরোপের সবুজ জ্বালানি উদ্যোগ: ইউরোপের বিভিন্ন দেশ নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপর জোর দিয়েছে, যা বায়ুদূষণ কমাতে সহায়ক হয়েছে।
অবশেষে ঢাকার বায়ুদূষণ আমাদের সকলের জন্য একটি তাৎক্ষণিক উদ্বেগের বিষয়। এই সংকট মোকাবিলায় প্রশাসনিক পদক্ষেপের পাশাপাশি নাগরিকদের সচেতনতা ও অংশগ্রহণ জরুরি। শিক্ষার্থী ও পরিবেশবাদীদের যৌথ প্রচেষ্টায় আমরা একটি পরিচ্ছন্ন, স্বাস্থ্যকর এবং বাসযোগ্য ঢাকা গড়ে তুলতে সক্ষম হবো।পরিবেশ রক্ষায় প্রতিটি পদক্ষেপই গুরুত্বপূর্ণ। আসুন, আমরা সবাই মিলে ঢাকার আকাশকে আবার নীল করে তুলি।